
ছোটবেলা থেকেই অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী সাংবাদিক শফিক মোহাম্মদের আবৃত্তি শেখার আগ্রহ ছিল। ১৯৯৮ সালে তিনি আবৃত্তি শেখার জন্য মাগুরা শহরের ইসলামপুর পাড়ার বাসিন্দা আবৃত্তিশিল্পী রকিবুল হক দিপুর কাছে যাওয়া শুরু করেন। তিনি কয়েকজন সমবয়সী বন্ধুর সঙ্গে আবৃত্তি শেখতে যেতেন। পরে সেই তরুণেরাই গড়ে তোলেন আবৃত্তি সংগঠন ‘কণ্ঠবীথি’।
প্রতি শুক্রবার চলত তাঁদের আবৃত্তি, শুদ্ধ উচ্চারণ ও বাংলা সাহিত্যচর্চার বৈঠক। সময় গড়ায়, শফিক উচ্চমাধ্যমিক শেষে ভর্তি হন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও তিনি আবৃত্তির চর্চা চালিয়ে যান ও সহপাঠীদের নিয়ে গড়ে তোলেন নতুন সংগঠন ‘আবৃত্তি আবৃত্তি’।
আবৃত্তিচর্চা থেকেই জন্ম নেয় তাঁর আত্মবিশ্বাস, উপস্থাপনা ও নেতৃত্বের দক্ষতা। পরে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন শফিক। সংবাদ উপস্থাপনা ও রিপোর্টিংয়ের পাশাপাশি কাজ করেছেন নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ বিভাগেও। এখন তিনি পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন অস্ট্রেলিয়ায়। নিজের জীবনযাত্রার এই গতিপথে কণ্ঠবীথিকে তিনি মানেন অন্যতম ভিত্তি হিসেবে। ‘স্কুলজীবনে কণ্ঠবীথির সঙ্গে যুক্ত না থাকলে হয়তো আজকের আমি হতাম না’—বলেন শফিক মোহাম্মদ। ‘কণ্ঠবীথি শুধু আবৃত্তি শেখায়নি, শিখিয়েছে কণ্ঠের স্পষ্টতা, আত্মবিশ্বাস আর সুন্দরভাবে ভাব প্রকাশের কৌশল—যা আমার সাংবাদিকতা জীবনের প্রতিটি ধাপে কাজে লেগেছে। এমনকি এখানেও (অস্ট্রেলিয়ায়) আমার চাকরিতে সেই আত্মবিশ্বাস ও দক্ষতা কাজে লাগছে।’
মাগুরায় গত ২৮ বছরে শফিকের মতো এমন অনেকের জীবন বদলে দিয়েছে কণ্ঠবীথি। এই সংগঠনের উদ্যোক্তাদের একজন আবৃত্তিশিল্পী রকিবুল হক বলেন, ‘শুদ্ধ উচ্চারণ, আবৃত্তি, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চাকে কেন্দ্র করে জন্ম নেওয়া এই সংগঠনের লক্ষ্য কেবল শিল্পচর্চা নয়—আলোকিত, দায়িত্বশীল ও সংস্কৃতিমনস্ক নাগরিক তৈরি করা।’ তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রতি শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে কণ্ঠবীথির নিয়মিত আবৃত্তি বৈঠক। মাগুরার মতো জেলা শহরে এমন ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক চর্চা একটা উদাহরণ তৈরি করেছে। বর্তমানে মাগুরা শহরের সৈয়দ আতর আলী গণগ্রন্থাগারের পেছনে একটি ভাড়া বাসায় চলে সংগঠনটির নিয়মিত কার্যক্রম। প্রথম থেকেই কণ্ঠবীথির দুটি বিভাগে (শিশু ও সাধারণ বিভাগ) সমান্তরালে কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে শিশু বিভাগে ৪০ ও সাধারণ বিভাগে ৩০ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছেন।
কণ্ঠবীথির সংগঠকেরা জানান, এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০০ জন সদস্য এই সংগঠনের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হয়েছেন। ‘যেখানেই থাকি, আমরা কণ্ঠবীথি’ স্লোগান ধারণ করেন সদস্যরা। এই সদস্যরা এখন দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত আছেন।
সংগঠনটির সদস্যদের একজন মাহমুদা ইয়াসমিন এখন ঢাকায় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় উন্নয়ন ও জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। একই সঙ্গে বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করা ‘ভৈরবী’ নামে একটি সংগঠনের পরিচালকের দায়িত্বে থাকা এই নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কণ্ঠবীথি আমাদের শুধু শুদ্ধ উচ্চারণ আর আবৃত্তি শেখায়নি, সেখান থেকে বাংলা সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে সমাজ গঠন, নেতৃত্ব, নিজেকে উপস্থাপন, যোগাযোগ—এগুলো শিখেছি। যা বিশ্ববিদ্যালয়জীবন, চাকরি—সবখানে কাজে লাগছে।’
সংগঠকেরা বলেন, বিদ্যালয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় শিশুরা। যার একটি বড় অংশ শিশুরা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায়। কণ্ঠবীথির শিশু বিভাগের পরিচালক আবদুর রমিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব শিশু নিয়মিত আবৃত্তি চর্চা করে তারা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ভালো করে। তবে যারা নিয়মিত চর্চা করে না, তারা ছিটকে পড়ে। আবৃত্তিচর্চা গুরুত্বপূর্ণ একটা দক্ষতা, যা সবার জন্য জরুরি। প্রতিটি ঋতু ও বিভিন্ন উপলক্ষে আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে কণ্ঠবীথি। মাগুরার সাংস্কৃতিক ক্যালেন্ডারে এখন একটি স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে সংগঠনটি। কণ্ঠবীথি তার আবৃত্তি প্রযোজনা নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পরিবেশনার সুযোগ পেয়েছে। শুধু দেশে নয়, ওপার বাংলার আবৃত্তি উৎসবেও নিয়মিত অংশ নিচ্ছে সংগঠনটি।
২০২৪ সাল থেকে কণ্ঠবীথির আয়োজনে শুরু হয়েছে ‘খান জিয়াউল হক স্বর্ণপদক আবৃত্তি প্রতিযোগিতা’। এ আয়োজনে সারা দেশের আবৃত্তিপ্রেমীদের একটা মিলনমেলায় রূপ নেয়।
কণ্ঠবীথির সদস্যরা বলছেন, দুই বাংলার আবৃত্তি অঙ্গনে কণ্ঠবীথি এখন একটি পরিচিত নাম। ২০২৪ সাল থেকে কণ্ঠবীথির আয়োজনে শুরু হয়েছে ‘খান জিয়াউল হক স্বর্ণপদক আবৃত্তি প্রতিযোগিতা’। এ আয়োজনে সারা দেশের আবৃত্তিপ্রেমীদের একটা মিলনমেলায় রূপ নেয়।
জানতে চাইলে সংগঠনটির আহ্বায়ক মাজহারুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাগুরার মতো ছোট শহরে কেবল আবৃত্তিকে কেন্দ্র করে সংগঠন টিকিয়ে রাখা চ্যালেঞ্জিং ছিল। নব্বইয়ের দশকে অনেকে বলতেন, ‘আবৃত্তির আবার সংগঠন হয় নাকি?’ কিন্তু আমরা থামিনি। আজ ২৮ বছর পরও আমরা একতাবদ্ধ, সমৃদ্ধ। আমাদের লক্ষ্য সব সময় ছিল আলোকিত মানুষ তৈরি করা।’
জেলা সংস্কৃতি কর্মকর্তা পার্থ প্রতিম দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলার সক্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর একটি কণ্ঠবীথি। তাঁরা নিয়মিত চর্চা করে আবার বছরে একাধিকবার বড় উৎসবের আয়োজন করে। তাঁদের এসব আয়োজনে আবৃত্তিশিল্পীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়।’