
এক কক্ষের পাকা একটি ঘর। তিন পাশে আলমারি। তাতে সাজানো সারি সারি বই। গল্প, উপন্যাস, দর্শন, ধর্ম আলাদা করে ভাগ করে রাখা হয়েছে বিষয় অনুযায়ী। রয়েছে কবিতা, কিশোর সাহিত্য, ইতিহাস, খেলাধুলা, বিজ্ঞান, রাজনীতির বইও। সামনে রাখা লম্বা টেবিলে কয়েকটি কাঠের চেয়ার। সেখানে বসে বইয়ের পাতায় মগ্ন কয়েকজন কিশোর ও বৃদ্ধ। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের গণপাঠাগারে গিয়ে চোখে পড়ল এমন দৃশ্য।
তবে শুধু মান্দারী নয়, লক্ষ্মীপুর জেলার ৫টি উপজেলার ৩৬টি ইউপি কার্যালয়ে গণগ্রন্থাগার স্থাপন করা হয়েছে। বাকি ২২টি ইউপি কার্যালয়ে গ্রন্থাগার স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন। লক্ষ্মীপুর জেলা ও উপজেলা প্রশাসন উদ্যোগী হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন গণগ্রন্থাগারগুলো। এতে যুক্ত হয়েছেন শিক্ষকসহ নানা পেশার মানুষ।
মান্দারী পাঠাগারে বই পড়ছিলেন লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিব হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসনের এই উদ্যোগে আমরা খুবই খুশি। গ্রামের তরুণদের উৎসাহ দেখে আমি মুগ্ধ। এটি গ্রামের শিক্ষাসহ নানা উন্নয়নের কেন্দ্রে পরিণত হবে, এটাই আমাদের স্বপ্ন।’
পাঠাগারে কথা হয় গ্রামের নবম শ্রেণির ছাত্র মো. ফয়সাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি এখন পাঠাগারে নিয়মিত আসেন। কবিতা ও গল্পের বই তার পছন্দ। তিনি বলেন, ‘স্কুলের সময়ের পর পাঠাগারে আসি। বই পড়ি। ভালো লাগে।’
মান্দারী ইউপি কার্যালয়ের প্রশাসক মো. সালেহ উদ্দিন বলেন, পাঠাগারে বর্তমানে ৩০০টি বই আছে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করা হয়। পাঠাগার সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন পাঠক আসেন। এখানে মাসিক সাহিত্য সভা, পুঁথিপাঠের আসরের আয়োজন করা হবে। পাঠকদের আগ্রহী করতে চা–নাশতার ব্যবস্থা রাখার চিন্তা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের বরাদ্দে ৫৮টি ইউপি কার্যালয়ে পাঠাগারগুলো করা হচ্ছে। প্রতিটি পাঠাগার স্থাপনে প্রায় দুই লাখ টাকা করে ব্যয় হয়েছে। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ৮টি, রায়পুরে ১০টি, রামগতিতে ৫টি, কমলনগরে ৪টি ও রামগঞ্জ উপজেলায় ৯টি ইউপি কার্যালয়ে পাঠাগার উদ্বোধন করা হয়েছে। ইউপি কার্যালয়ে গণপাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ লক্ষ্মীপুর জেলাতেই প্রথম।
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ জে এম ফারুকী বলেন, মানুষের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে। বইয়ের ওপর আগ্রহী করতে ইউপি কার্যালয়ে গণগ্রন্থাগার করার উদ্যোগটি ভালো। তবে গ্রন্থাগারে কী ধরনের বই থাকবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। যদি সেখানে আকর্ষণীয় বই দেওয়া হয়, তাহলে পড়তে আগ্রহী হবে তরুণেরা। কিন্তু সেখানে যদি মন্ত্রী বা সরকারের নিজস্ব বই থাকে, তাহলে পাঠক সেখানে যেতে আগ্রহ দেখাবে না।
প্রথম আলোর উদ্যোগে ২০২১ সালে ওআরজি-কোয়েস্ট পরিচালিত এক জরিপে উঠে আসে ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে তরুণদের পাঠ্যসূচির বাইরের বই পড়ার হার প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ কমেছিল। ইউপি কার্যালয় হলো প্রশাসনের সর্ব শেষ স্তর। এখানে প্রতিদিন অনেক লোক সেবার জন্য আসেন। সেবা পেতে তাঁদের অপেক্ষা করতে হয়। তখন তাঁরা পাঠাগারে সময় কাটাতে পারেন।
পাঠাগারগুলোকে ঘিরে গ্রামের শিক্ষা, সামাজিকতায় পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছেন লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার। তিনি বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের অনেক সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু ছাপা কাগজের বইয়ের ঘ্রাণ, তার মূল্য আলাদা। আলোকিত মানুষ হতে হলে বই পড়তে হবে। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে আমরা এর অভাব বোধ করি। এই পাঠাগার আমাদের নতুন প্রজন্মকে আলো দেবে, আলোকিত করবে। এই চিন্তা থেকে এটিকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি আমরা।’