চা-বাগানের পথে পথে তখন ঘরে ফেরা মানুষের সারি। কারও পিঠে শূন্য ঝোলা, কারও কাঁধে বা মাথায় শুকনা কাঠ কিংবা ঘাসের আঁটি। কেউ কাজ শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফিরছেন, কেউ আবার সপ্তাহের মজুরি নিতে চা-বাগানের অফিসের দিকে পা বাড়িয়েছেন। তবে এই সারির বেশির ভাগ মানুষই এগোচ্ছেন সপ্তাহের এক বেলার হাটের দিকে।
ওই দিনই তলববার—সপ্তাহের মজুরি পাওয়ার দিন। নানা দিক থেকে চা-শ্রমিক, তাঁদের পরিবার ও বাগানসংলগ্ন গ্রামের মানুষ একসঙ্গে মিশে ভিড় করছেন হাটে।
মৌলভীবাজারের রাজনগর চা-বাগানের হাসপাতাল টিলা এলাকায় এই সাপ্তাহিক হাট বসে প্রতি বৃহস্পতিবার। সপ্তাহে এক দিন, মাত্র এক বেলা। সাধারণত বেলা তিনটার দিকে হাট শুরু হয়। সময় গড়ালে তলব পাওয়া লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে। সন্ধ্যা নামলেই লোকারণ্য হয়ে ওঠে বাজার। মাছ, সবজি-আনাজ, শুকনা খাবার থেকে শুরু করে নানা রকম গৃহস্থালির জিনিস—সবই কেনাবেচা হয় এই হাটে।
গত বৃহস্পতিবার সেই হাটে গিয়ে কথা হয় নিমাই শুক্ল বৈদ্য নামের একজনের সঙ্গে। চা–বাগানে কাজ করেন তিনি, তলবের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে হাটে সাজানো পণ্য দেখছিলেন।
নিমাই শুক্ল বৈদ্য বলেন, ‘আমি বাগানের শ্রমিক আছি। বৃহস্পতিবার এখনো তলব পাইনি। তলব পাইলে বাজার করমু। এক সপ্তাহে বারো শ (১ হাজার ২০০ টাকা) টাকা পাইমু। এই টাকায় কী হবে ভাই, কিছু হয় না। বাইচ্চা-কাইচ্চার পড়ালেখা চলে না। দুই-তিন দিন ভালোটিকে খাওয়া যায়, এই আরকি।’
বেলা তিনটার পর থেকে বাজার জমতে থাকে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা পণ্য নিয়ে আসেন। অনেকে আছেন ২০-২৫ বছর ধরে এই এক দিনের হাটে নিয়মিত আসছেন। টেংরা বাজার, ব্রাহ্মণবাজার, তারপাশাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁরা পণ্য এনে বিক্রি করেন।
হাট ঘুরে দেখা গেছে, উত্তর পাশের সারিতে কয়েকজন ব্যবসায়ী মাছ নিয়ে বসেছেন। শুঁটকি বিক্রি করছেন কেউ কেউ। মৌসুমি শাকসবজির দোকানও বেশ কয়েকটি। দোকানে লালশাক, লাইশাক, ফুলকপি, বেগুন, মুলা, আলুসহ বিভিন্ন সবজি সাজানো। বহু দোকানে আবার শুকনা খাবার বিক্রি হচ্ছে। আছে জুতা, কাপড়, প্রসাধনী সামগ্রীর দোকান।
ব্যবসায়ী সুফিয়ান খান বলেন, প্রতি বৃহস্পতিবার তিনি টেংরা থেকে সবজি নিয়ে রাজনগরের এই হাটে আসেন। চার-পাঁচ বছর ধরে তাঁর এ যাতায়াত চলছে।
প্রায় ২৫ বছর ধরে ব্রাহ্মণবাজার থেকে নিজের তৈরি শুকনা মিষ্টিজাতীয় খাবার নিয়ে হাটে আসছেন মোহন কানু। দোকানে পুঁটলি বেঁধে সাজানো হয়েছে খাজা, বুন্দিয়া, নিমকি, মিষ্টি, জিলাপি, গুড়ের কাটা গজা, চিনির গজা, চানাচুর, শিঙাড়া, পেঁয়াজু নানা খাবার। সন্ধ্যার আগপর্যন্ত ভিড় তুলনামূলক কম থাকলেও সন্ধ্যা নামতেই কেনাকাটা জমে ওঠে। মোহন কানু বলেন, ‘আগে বাবা আইতা (আসতেন)। এখন আমি আসি। আমি নিজের হাতে সবকিছু বানাই। এখানে যা চলে, তা নিয়া আই (আসি)।’
হাটের মুখেই দেখা মিলল এক নরসুন্দরের। তিনি টুলে বসিয়ে চুল-দাড়ি কাটছেন। এই প্রথা বেশ পুরোনো হলেও এখনো অনেক গ্রামীণ হাট টিকে আছে। হাটে প্রবেশপথের দুই পাশে বেতের টুকরি, ঝাঁকা, পান-সুপারি, মসলাপাতি, প্রসাধনী, আইসক্রিম, চানাচুরসহ নানা দোকান। একজন বিক্রেতা আবার সাউন্ড বক্স বাজিয়ে ডিজিটাল ঘড়ি বিক্রি করছিলেন।
গাইবান্ধার আব্দুল করিম জানান, তিনি ১০-১৫ বছর ধরে এই হাটে ‘গরমমসলা’ বিক্রি করেন। তাঁর ১০০ টাকার প্যাকেটে থাকে লং, এলাচি, দারুচিনি ও জিরা বাখর। আব্দুল করিম বলেন, ‘সব হাটে আসি না। এটা একবার কিনলে অনেক দিন যায়, এ জন্য দুই–এক বাজার মিস করি।’
এ সময়ের মধ্যে হাট লোকারণ্য হয়ে ওঠে। নারী-পুরুষ শ্রমিকেরা তলব পেয়ে হাটের দিকে ছুটেছেন। মানুষের ভিড়ে জমে ওঠে। যার যা সামর্থ্য, সেই অনুযায়ী সবজি, মাছ, মসলা কিনছেন। কেউ জুতা-কাপড় নিচ্ছেন, কেউ শিশুদের জন্য খেলনা। সন্ধ্যার পর সবার হাতেই তখন বাজারের ঝোলা। কেনাকাটা করে অনেকে বসতবাড়ির দিকে ছুটছেন। রাত আটটা-নয়টা পর্যন্ত বাজার চলে। তারপর নেমে আসে চা-বাগানের স্বাভাবিক নীরবতা।