মানবসভ্যতার ইতিহাসে মৌমাছির সঙ্গে পরিচয় প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই। পবিত্র কোরআন, বেদ, রামায়ণসহ নানা ধর্মগ্রন্থ ও প্রাচীন সাহিত্যে এই উপকারী পতঙ্গের কথা উল্লেখ আছে। মৌমাছির ধারাবাহিক পরিশ্রম, একতা ও আত্মত্যাগ মানুষের জন্য অনুকরণীয়। এক ফোঁটা মধু সংগ্রহে একটি শ্রমিক মৌমাছিকে চষে বেড়াতে হয় ৪০০ থেকে ৫০০টি ফুলে। এরাই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরাগায়নের মাধ্যমে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় মৌমাছি একটি নির্ভরযোগ্য জীব। যদি মৌমাছি বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে মানুষসহ গোটা প্রাণিকুল বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জাতিসংঘ ২০১৮ সাল থেকে ২০ মে বিশ্ব মৌমাছি দিবস পালন করছে। দিনটি পালনের মধ্য দিয়ে মৌমাছির গুরুত্ব অনুধাবনের আহ্বান জানানো হয়।
খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, ‘বিশ্ব মৌমাছি দিবস পালনের উদ্যোগ মৌমাছির গুরুত্ব অনুধাবনে আমাদের সহায়তা করে। বসন্তে যখন গাছে ফুল ফোটে, মৌমাছি ফুলের মৌ–রস ও পরাগরেণু সংগ্রহ করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ পরাগায়ন ঘটায়।’
গবেষণার তথ্যের বরাত দিয়ে এই অধ্যাপক জানান, ৯০ শতাংশ বন্য ফুল, ৭৫ শতাংশ ফসল ও ৩৫ শতাংশ বৈশ্বিক কৃষির পরাগায়নের পেছনে মৌমাছির ভূমিকা রয়েছে।
বিদেশ রঞ্জন মৃধা আরও বলেন, ‘মৌমাছির সঙ্গে মানুষের গভীর মিল রয়েছে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, “যদি মৌমাছি পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়, তবে মানুষের জীবন পরবর্তী চার বছরে শেষ হয়ে যাবে।” মৌমাছি ছাড়া মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।’
উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের টিকে থাকার ওপর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবন, অর্থনীতি ও উন্নয়ন নির্ভরশীল। এই বন টিকিয়ে রাখতে মৌমাছির পরাগায়ন কৌশলই সবচেয়ে কার্যকর। মৌমাছি না থাকলে পরাগায়ন কমে যাবে, কমবে গাছের বংশবৃদ্ধির হার।
সুন্দরবনে এখন মৌমাছির চাক থেকে মধু আহরণের মৌসুম চলছে জানিয়ে কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, এই মৌসুমে বনের গাছে গাছে ফুল আর ডালে ডালে ঝুলে থাকা মৌচাকগুলো সুন্দরবনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। সুন্দরবনের সঙ্গে মৌমাছির নিবিড় সম্পর্কই ম্যানগ্রোভ বনটিকে হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে ভূমিকা রেখে চলেছে। জঙ্গলের গহিনে মৌচাকে মধু জমায় মৌমাছি। আর মৌমাছির কষ্টের ধন ‘মধু’ ভোগ করে মানুষ। আসলে ক্ষুদ্র এই জীবের বিপুল পরিশ্রমের পুরোটা ফল ভোগ করে মানুষ ও পরিবেশ।
আজ মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রামের আলওয়ান মধু জাদুঘর ও গবেষণাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ মুহাম্মদ মঈনুল আনোয়ারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি মৌমাছির বসত সুন্দরবনে। পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রজাতির মৌমাছি থাকলেও আমাদের দেশে সাধারণত পাঁচ রকম মৌমাছির দেখা মেলে। তবে এর মধ্যে সুন্দরবনে শুধু “অ্যাপিস ডরসেটা” ও “স্ট্রিং-লেস” প্রজাতির মৌমাছির দেখা পাওয়া যায়।’
সৈয়দ মুহাম্মদ মঈনুল আনোয়ার জানান, অ্যাপিস ডরসেটা মৌমাছি কিছুটা আগ্রাসী ও বড় আকৃতির। চৈত্র-বৈশাখ মাসের দিকে এরা সুন্দরবনে আসে। দুই থেকে আড়াই মাস সেখানে থাকে। আর স্ট্রিং-লেস মৌমাছি অত্যন্ত ছোট আকৃতির হয়। গাছের গর্তে বাসা তৈরি করে তারা। গাছ চিরে এদের মধু সংগ্রহ করতে হয়। অন্য সব মৌমাছির বাসা ষড়্ভুজাকৃতির হলেও এদের ঘর গোলাকৃতির হয়। খুব কম মধু পাওয়া যায় এদের বাসা থেকে।
গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. রুহুল আমীন বলেন, মানবজীবনকে টিকিয়ে রাখার নেপথ্যে আছে মৌমাছির বিরামহীন পরিশ্রম। একটি কর্মী মৌমাছি তার জীবনকালে ১ বর্গকিলোমিটার বা ৭০০ হেক্টর ফসলি মাঠে বিচরণ করতে পারে। একটি মৌচাকের সমগ্র কর্মী মৌমাছি বছরে চার বিলিয়ন ফুলের পরাগায়ন করতে সক্ষম। মৌমাছির পরাগায়নের মাধ্যমে ফসলের ফলন এবং ফল ও বীজের গুণগত মান বাড়ে। সপুষ্পক উদ্ভিদের ৮০ শতাংশের পরাগায়ন মৌমাছি দিয়ে হয় এবং মানুষের মোট খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশ মৌমাছির পরাগায়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।