Thank you for trying Sticky AMP!!

পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের নাচ শেখানোর ভাইরাল ভিডিও ও এক নাচের শিক্ষকের গল্প

রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার করেঙ্গাতলী বাজার এলাকায় বঙ্গলতলী ইউনিয়ন পরিষদ হলরুমে নাচ শেখাচ্ছেন শুভতম চাকমা। গত শুক্রবার সকালে

বিদ্যালয়ের সবুজ আঙিনায় ১০-১২ জন শিক্ষার্থীকে নাচের তালিম দিচ্ছেন সাদা টি–শার্ট পরা এক তরুণ। পেছনে বাজছে একটি গান, ‘চল চল সখী ঘাটে জল আনিতে যাই’। গানের তালে তালে নাচের মুদ্রা ফুটিয়ে তুলছেন তরুণ প্রশিক্ষক। তাঁকে অনুসরণ করছে শিক্ষার্থীরা। নাচের ছন্দ আর তাল কোথাও এতটুকু কাটেনি। দলগত নাচের এই দৃশ্য দেখতে দেখতে মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে পড়ে।

কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। গত ২৪ আগস্ট আপলোড করা এই ভিডিও এখন পর্যন্ত ৬৬ লাখ বার (৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন) দেখা হয়েছে। রাঙামাটির বাঘাইছড়ির একটি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ধারণ করা এই ভিডিও ১৭ হাজার শেয়ার হয়েছে। প্রশংসায় ভাসছেন তরুণ নাচের প্রশিক্ষক। নেট-দুনিয়ার অনেকে ভিডিওটি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘সাংস্কৃতিক শিক্ষা যেখানে উঠে যাচ্ছে, সেখানে এমন দৃশ্য মনে আশা জাগায়।’  

বাঘাইছড়ির এই নাচের প্রশিক্ষকের নাম শুভতম চাকমা। উপজেলার খেদারমারা ইউনিয়নের পাবলাখালী গ্রামের বাসিন্দা তিনি। ২২ বছর বয়সী শুভতম রাঙামাটি সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ২০১৮ সাল থেকে স্কুলের শিক্ষার্থীদের নাচের তালিম দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী উপজেলা, জেলা এমনকি জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বর্তমানে তাঁর অধীনে ২৫০ জন শিক্ষার্থী নাচের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়েছেন ছয়টি নাচের দল। এর মধ্যে বঙ্গলতলী ইউনিয়নের করেঙ্গাতলী গ্রামে একটি, জীবঙ্গাছড়ায় দুটি, বাঘাইছড়িতে একটি ও খেদারমারা গ্রামে দুটি নাচের দল রয়েছে তাঁর। তাঁর দলের প্রশিক্ষণার্থীরা নিম্নমাধ্যমিক, উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী। বাঘাইছড়ি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের পাশাপাশি রাঙামাটি জেলা শহরেও তিনি নাচের তালিম দেন।

গত আগস্ট মাসে বাঘাইছড়ির কাচালং বালিকা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে তাঁর নাচের প্রশিক্ষণের ভিডিওটি ভাইরাল হয়। এই বিদ্যালয় ছাড়াও এলাকার কমিউনিটি সেন্টার এবং ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে তিনি নাচ শেখান। গত শুক্রবার সকালে বঙ্গলতলী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নাচ শেখানোর ফাঁকে কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। ভাইরাল ভিডিওর প্রসঙ্গ তুলতেই লাজুক হাসি দেন শুভতম চাকমা। জানালেন ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। কিন্তু কোনো দিন ভাবেননি নাচের শিক্ষক হবেন। এখন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামেও নাচের শিক্ষক হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে। নাচ শিখিয়ে আয়ের উদ্দেশ্য নেই তাঁর। যা আয় হয় তা দিয়ে লেখাপড়ার খরচ চলে। মূলত ভালোবাসার তাগিদেই নাচ শেখান শিশু-কিশোরদের। অনেক দুর্গম এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের নাচ, গান ও নাটক শেখাচ্ছেন বিনা মূল্যে। শিক্ষার্থীদের নৃত্য শেখার দৃশ্য মাঝেমধ্যে ফেসবুকে আপলোড করেন। এমন কয়েকটি ভিডিও এখন ভাইরাল হয়েছে।

নাচের প্রতি এমন আগ্রহ কী করে জাগল—জানতে চাইলে শুভময় বলেন, ছোটবেলায় তাঁদের গ্রামে ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলে, সেই অনুষ্ঠানে তিনি নাচে অংশগ্রহণ করতেন। তাঁর নাচ দেখে সুমিতা চাকমা নামের একজন শিক্ষক উপজেলা সদরে এসে নাচ শেখার প্রস্তাব দেন। তাঁর উৎসাহে উপজেলার জীবঙ্গাছড়ায় কণিকা ত্রিপুরা নামে একজনের কাছে নাচের প্রশিক্ষণ নেন। পরে ২০১৭ সালে ৫ ডিসেম্বর উজোনী শিল্পীগোষ্ঠী নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠন করেন। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকার অবহেলিত মানুষকে নাচ, গান ও নাটকের মাধ্যমে সচেতন করা। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর তিনি বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করেন। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নাচ, গান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হতে থাকে। এভাবে সবার নজরে পড়ে যান। নাচের শিক্ষক হিসেবেও ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম।

উপজেলা সদরের জীবঙ্গাছড়া বাবুপাড়ার কমিনিটি সেন্টারে নাচ শেখাচ্ছেন শুভতম চাকমা। গত শুক্রবার বিকেলে

গ্রামের একটি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন শুভতম। বাবা বিপিন চাকমা পার্বত্য আঞ্চলিক দলের সঙ্গে যুক্ত। পাঁচ ভাইবোনের সবার ছোট তিনি। ২০২০ সালে করোনোয় আক্রান্ত হয়ে তাঁর মা মারা যান।

বাঘাইছড়ি সদরের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী স্নিগ্ধা বড়ুয়া (৯) শুভতমের কাছে নাচ শিখে এবার উপজেলা পর্যায়ে প্রথম হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত তার মা মমি বড়ুয়া। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে সন্তানের নাচ-গান শেখানোর কোনো সুযোগ পাইনি। তাই শুভতম চাকমার কাছে মেয়েকে পাঠিয়েছি। তাঁর দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হতে হয়।’

কাচালং বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক সুনন্দা তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে সাংস্কৃতিক শিক্ষক নেই। সেই অভাব পূরণ করছেন শুভতম চাকমা। আমাদের অনেক শিক্ষার্থীকে তিনি নাচ ও গানের প্রশিক্ষণ দেন।’

শুভতম এখন বাঘাইছড়ির সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অবিচ্ছেদ্য নাম। বাঘাইছড়ির কাচালং সরকারি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক ও সাবেক বাঘাইছড়ি শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক মো. কামাল হোসেন তেমনটাই মনে করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাঘাইছড়ি উপজেলায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শুভতম চাকমার ভূমিকা অসাধারণ। নিজের চেষ্টায় ভালো মানের নৃত্যশিল্প হয়ে উঠেছেন। বিভিন্ন পাড়ায় গিয়ে শিশুদের নাচ ও গান শেখাচ্ছেন। এমনকি দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে নাচ, গান ও নাটকের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করছেন।