
তাঁর প্রিয় বেলা সন্ধ্যা, প্রিয় ঋতু শীত, প্রিয় সময় একা থাকা, প্রিয় জায়গা নির্জন ছাদ, প্রিয় যানবাহন পায়ে হেঁটে চলা অথবা রিকশা, প্রিয় অভ্যাস একটুতেই কান্না পাওয়া, প্রিয় ব্যথা তিরস্কার। তাঁর এমন ৫৬টি প্রিয় জিনিসের তালিকায় প্রিয় রোগের নামও রয়েছে, তা হলো জ্বর আর মৃত্যু। বিচিত্র ভাবনায় ভরা ১৮ বছর বয়সী একটি মেয়ের প্রেমের ডায়েরিতে লেখা রয়েছে এসব।
১৩ বছর আগে রাজশাহী নগরের ডিঙ্গাডোবা এলাকার এক ভাঙারির দোকানে ডায়েরিটি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আব্দুল্লাহ বাকি। পড়তে দিয়েছিলেন। পড়ি পড়ি করে হারিয়ে ফেলি। পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে গত ৮ ডিসেম্বর সকালে ডায়েরিটি পেয়ে যাই। পাতা উল্টাতে গিয়েই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
শুরুতে রয়েছে ৪৮টি উপদেশবাণী, আর শেষে রয়েছে ১৩টি কবিতা ও কয়েকটি পেনসিল স্কেচ। পুরো ডায়েরির লেখা কয়েকটি পর্বে ভাগ করা। প্রথম পর্বের নাম ‘নিজের অজান্তে’, তারপর ‘মনের ক্ষুধা’, ‘কিছু কথা’, ‘মনের কথা’, ‘হাবা’ ও সবশেষে রয়েছে ‘প্রেম পর্ব।’ এই প্রেমের শুরু আছে। শেষ নেই। তবে আছে ভয়াবহ পরিণতি।
২০০০ সালের ১১ নভেম্বর মেয়েটি ‘নিজের অজান্তে’ পর্বে তাঁর একটি প্রিয় মুখকে কল্পনা করতে গিয়ে সেদিনের প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘সময়ের বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার ভালোবাসার আঙিনায় অভিনন্দন একজন মিষ্টি মনের চরিত্রবান ছেলেকে, যে হবে আমার চতুর্দশী চন্দ্রিমা। যার মন আছে, অভিমান নেই। রূপ আছে অহংকার নেই। হৃদয় আছে ছলনা নেই। শেষ পরিণতিতে নেই তার কোনো প্রতারণার চিহ্ন। চারপাশে পিনপতন নিস্তব্ধতা। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। প্রান্তরের বুকে গলে গলে পড়ছে জোছনার শরীর। এত সুন্দর এই রাত! একেবারে পূর্ণ যুবক-যুবতীর মতো। আমার মুগ্ধতা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। আমি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছি। সৌন্দর্যময় এই রাতের দিকে। আহ! কী অপূর্ব এই দৃশ্য। গভীর থেকে গভীরতায় এক অনুভূতি আমাকে নিমজ্জিত করে ভাবের সমুদ্রে। আমার ভাবনাগুলো টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আবার জোড়া লাগে। আবার ছিঁড়ে যায়। রাতের এই নিঃসীম নির্জনতায় অনুভূতির গভীরতা থেকে বেরিয়ে আসে এক অপার্থিব সুন্দরের মুখ। আমি আবেশমথিত হৃদয়ে তাড়াতাড়ি মনঃসংযোগ করে আর্ট পেপারে আঁকতে চেষ্টা করি সেই মুখ কিন্তু ছবিটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই দ্রুত মিলিয়ে যায়। অসম্পূর্ণতার দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে আমি বারবার চেষ্টা করি কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও পূর্ণতা দিতে পারি না আমার কল্পনার প্রিয়কে। অন্তবিহীন বেদনায় বুকের ভেতরটা ভেঙে আসতে থাকে। আমি ছোট শিশুর মতো চিৎকার করে বলি তুমি সুন্দর, খুব সুন্দর কিন্তু মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। আমি আঁকতে পারি না।’
হঠাৎ একদিন সেই প্রিয় মানুষটিকে তিনি পেয়ে যান। পাওয়ার অনুভূতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। এলোমেলো হাওয়ায় ঘরে-বাইরে গাছগাছালিতে ঠিকরে পড়া চাঁদের আলোয় নিচের ছায়াগুলো নাচানাচি করছে। নানা ধরনের গন্ধ এসে নাকে লাগছে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে আমার মনপ্রাণ জুড়িয়ে দিয়ে গেল। অপার্থিব একটা সুখানুভূতি বুকের ভেতরে ঢেউ খেলে গেল। ভালো লাগার নেশা-চোখে আমি বলি, কী অপূর্ব এ সৃষ্টি!’
তারপর বিভিন্ন পর্বে অনেক অনেক কথা। আগামীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে লিখেছেন, ‘ঘুমন্ত নারীকে জাগাবার আগে তুমি তাকে একটা কবিতা শুনাবে।’ এভাবে তাঁর চুলের বেণি, শাড়ির আঁচল, কপালের টিপ ও প্রস্ফুটিত মুখে আদর দেওয়ার কাব্যিক বর্ণনা দিয়েছেন।
কিন্তু এই কাব্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ২০০১ সালের মাঝামাঝি এসেই সব তছনছ হয়ে গেছে। দুই পরিবারে জানাজানি, ছেলের পরিবারের বিয়েতে অমত। আরও ঝামেলা। ছেলের হাজতবাস। মেয়ে গৃহবন্দী। ওই বছর ২ মে তাঁদের শেষ দেখা হয়। তারপরও ছেলেটি চিঠি দিয়েছেন। চিঠি পেয়ে মেয়েটি লিখেছেন, ‘শান্তি পেলাম। ভাবলাম এভাবেই হয়তো চিঠি লেনদেন হবে।’ একসময় সেই চিঠিও বন্ধ হয়ে গেল। শেষের দিকে ছেলের চিঠির ভাষা খারাপ হয়ে যায়। মেয়েটি ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘তোমার বাবার কত টাকা আছে, তুমি আমাকে কত টাকা দেবে? টাকা দিয়ে আমার শুধু টাকার একটা কাফন হবে!’
এরপর ডায়েরিতে আর কোনো লেখা নেই। অনেকগুলো পাতা খালি ছিল। তাতে বাড়ির কোনো শিশু আঁকিবুঁকি করে ২০০৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি স্বাক্ষর করেছে। তাতে বোঝা যায়, ডায়েরিটি সেই সময় পর্যন্ত বাড়িতেই ছিল। তারপরেই হয়তো কোনো এক সময় মালিকানাহীন ডায়েরিটির ঠাঁই হয়েছে ভাঙারির দোকানে। ডায়েরিতে মেয়েটির নাম আছে। একটি ডাকনামও আছে, কিন্তু পূর্ণ ঠিকানা নেই। একটি ফোন নম্বর আছে, তবে গ্রামীণফোনের নম্বর যখন ১০ ডিজিটের ছিল, তখনকার। মেয়েটির একটি কবিতার শেষাংশে ছিল—‘একটাই তো জীবন/ একটাই তো মন/ এসো জীবনে জীবনে/ দিগন্তের চেয়ে বহু দূরে হারাই দুজন।’ জানা যায়নি এই কবিতা সত্যি হয়েছিল কি না।