
কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাটের তিনটি বসতঘরের চারদিকে বর্জ্য ফেলছে পৌরসভা। পৌরসভার কোনো স্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন না থাকায় নদী তীরেই বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এতে ভরাট হচ্ছে নদীর অংশবিশেষ। ওই এলাকায় আগে থেকে বসবাস করা তিনটি পরিবারের বসতভিটার চারদিকে গড়ে উঠেছে প্রায় ৪৫ উঁচু বর্জ্যের স্তূপ। বর্জ্যের এই ‘পাহাড়’ ডিঙিয়ে তিন পরিবারের ১৫ সদস্যকে যাতায়াত করতে হয়। পোকা-মাকড়, মাছি আর দুর্গন্ধ সয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের। বসতবাড়িগুলোতে এই কোনোটিতেই বিদ্যুৎ-সংযোগ, নলকূপ। মাছি, পোকামাকড়ের জন্য রাতে ঘুমাতেও পারেন না বাসিন্দারা।
চারদিকে বর্জ্যের পাহাড়, মাঝে ছোট এক টুকরা জায়গায় পাশাপাশি তিনটি টিনের ঘরে থাকেন তিন পরিবারের ৭ শিশুসহ অন্তত ১৫ জন নারী-পুরুষ। ওই জায়গায় যেতে হয় ৪৫ ফুট উঁচু বর্জ্যের স্তূপ ডিঙিয়ে। স্থানীয় লোকজনের ভাষায় ময়লার পাহাড়।
বসতভিটায় সারা দিন মশা-মাছির উৎপাত, কাক, কুকুর ও পোকামাকড়ের রাজত্ব। ঘরের ভেতরেও মশা-মাছির ভনভন শব্দ, পোকামাকড়ের ঘরবসতি। সামান্য বৃষ্টিতে ডুবে যায় ঘর। তখন রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া, গোসল কোনোমতে সামলানো গেলেও ঘুমানো যায় না। কিলবিল করে ছুটতে থাকে পোকামাকড়। কক্সবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্র বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট হতদরিদ্র তিন পরিবার এমন দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
কক্সবাজার শহরের প্রধান নদী বাঁকখালী এখন দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও শহরের ময়লা-আবর্জনা ফেলে কস্তুরাঘাট এলাকার নদীর তলদেশ ভরাট চলছে।
পোকামাকড়ের ঘরবসতি
কস্তুরাঘাট বদরমোকাম জামে মসজিদ থেকে দুই লেনের সদ্য নির্মিত পাকা সড়ক ধরে বাঁকখালী সেতুর দিকে ৫০০ থেকে ৬০০ ফুট গেলে সামনে পড়ে তিন রাস্তার মোড়। তার পূর্ব পাশে আড়াই বর্গ একর ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে গোলাকৃতির ৪০ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু বর্জ্যের পাহাড়।
গত সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, পৌরসভার দুটি ট্রাকে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। একটি খননযন্ত্র দিয়ে সেই বর্জ্য চাপা দেওয়া হচ্ছে। বর্জ্যের স্তূপ ডিঙানো ছাড়া তিন পরিবারের বসতবাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু স্তূপে পা রাখলেই বৃষ্টির পানিতে পচে নরম হওয়া আবর্জনার গভীরে ঢুকে যায়। ওই অবস্থায় কোনোমতে ঘরগুলোতে গিয়ে যা দেখা গেল, তা রীতিমতো অবর্ণনীয়। ময়লার গাদায় ঘরের সামনে-পেছনে খোলা জায়গাতে হাঁস-মুরগি, গরুর সঙ্গে খেলছে কয়েকটি শিশু। ঘরগুলোর এক পাশে ভাঙা একটি শৌচাগার।
তিনটি বাড়ির কোনোটিতেই বিদ্যুৎ-সংযোগ নেই। নেই নলকূপ। দেড়-দুই কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন পরিবারের লোকজন। সন্ধ্যায় যখন আশপাশের বহুতল ভবনে বিজলি বাতি জ্বলে ওঠে, তখন তিনটি ঘরে নেমে আসে অন্ধকার।
জোড়াতালি দেওয়া একটি ঘরের মালিক সেতারা বেগম। বাড়ি বরিশালের কাউখালীর সুবিদপুরে। নদীভাঙনে হারিয়ে ফেলেন ভিটেবাড়ি। এরপর জীবিকার সন্ধানে স্বামী ও ছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে ছুটে আসেন কক্সবাজার শহরে। ২০০৮ সালে পৌরসভার সাবেক মেয়র সরওয়ার কামাল নদীর ভরাট হওয়া একখণ্ড জায়গায় তাঁদের থাকতে দেন। সেখানে তৈরি করা হয় টিনের এই ঘর। তখন ঘরের আশপাশে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হতো না। কয়েক বছরের মাথায় সেখানে তৈরি হয় আরও দুটি টিনের ঘর।
সেতারা বেগম (৬০) প্রথম আলোকে বলেন, ১০ থেকে ১২ বছর ধরে তাঁর ঘরের চারপাশে শহরের ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ শুরু হয়। এখন ঘরের চারপাশে বর্জ্যের পাহাড় দাঁড়িয়ে গেছে। গাড়ি থেকে যখন ময়লা ফেলা হয়, তখন মনে হয় মাথার ওপর এসে পড়ে। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারেন না উচ্ছেদের ভয়ে। দুর্গন্ধ আর পোকামাকড়ের সঙ্গে বসবাস করছেন। অন্য কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলে চলে যাবেন বলে জানান তিনি।
সেতারার ঘরটির চারদিকে ভাঙা টিন, পলিথিন ও ত্রিপল দিয়ে ঘেরা। ভেতরে মশা-মাছির উৎপাত। বৃষ্টির পানিতে সয়লাব ঘরের মেঝে। সেখানে ব্যাঙ, ইঁদুর, মাকড়সা, বিচ্ছুসহ পোকামাকড় ঘুরছে।
১৫ বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেন সেতারা। তখন শুঁটকি মহালে শ্রমিকের কাজ করতেন। ময়লা-আবর্জনায় থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। স্বামী বেঁচে থাকতে চার মেয়ে এবং কয়েক বছর আগে আরও দুই মেয়ের বিয়ে হয়। এখন ঘরে আছে ২২ বয়সী এক ছেলে। দিনমজুরি করে ছেলে যা আয় করে, তা দিয়ে দুবেলা খাবার জোটে না।
সেতারার পাশের ঘরটি কুলসুমা বেগমের। কুলসুমা বেগম (৪৫) বলেন, ‘রাতে ঘুমাতে পারি না, পোকা কামড়ায়। দুর্গন্ধে নিশ্বাস নিতে পারি না। তবুও বেঁচে আছি, সন্তানদের নিয়ে।’
এক দশক আগেও সন্তানদের নিয়ে কুলসুমা থাকতেন শহরের পেশকার পাড়ার একটি ভাড়া বাসায়। একটা সময় এখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন। স্বামী দিনমজুর। আয়রোজগার যা হয়, তা দিকে সংসার চলে না। বাড়তি আয়ের জন্য কুলসুমা ময়লা থেকে লোহা, প্লাস্টিক ও পানির বোতল সংগ্রহ করেন।
কুলসুমার পাশের ঘরটিতে তালা ঝুলছে। প্রতিবেশীরা জানান, এই ঘরের লোকজন বর্জ্যের পাহাড়ে লোহা ও প্লাস্টিকসামগ্রী কুড়াতে গেছেন, ফিরবেন সন্ধ্যায়।
বর্জ্যের ‘পাহাড়ে’ কথা হয় ট্রাকে ময়লা ফেলতে আসা পৌরসভার কয়েকজন-পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁদের একজন বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ ট্রাক ময়লা ফেলি। ময়লা থেকে ছড়ানো দুর্গন্ধে নিজেরা টিকতে পারি না। অথচ ময়লার ডিপোর ভেতরে তিনটি পরিবার বছরের পর বছর কীভাবে থাকছে, অবাক লাগে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের পরিচালক মো. জমির উদ্দিন বলেন, বাঁকখালী নদীতে বর্জ্যের পাহাড় দেখেছেন তিনি, কিন্তু তার ভেতরে মানুষের বসতি আছে, তা তাঁর জানা নেই। স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে বাঁচাতে পৌরসভা চাইলে পরিবারগুলোকে অন্যত্রে পুনর্বাসন করতে পারে।
তিন দশকেও হয়নি ডাম্পার স্টেশন
শহরের এক সময়কার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র কস্তুরাঘাটে নদীর কয়েক শ একর ভূমি ভরাট করা হয়েছে ময়লা ফেলে। তিন দশকেও ময়লা-আবর্জনা ফেলার একটি ডাম্পার স্টেশন তৈরি করতে পারেনি পৌর কর্তৃপক্ষ। পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, শহরে প্রতিদিন উৎপন্ন হয় ৯৭ টনের বেশি বর্জ্য। এর মধ্যে ৭০ টন বর্জ্য নদীর কস্তুরাঘাট এলাকায় ফেলা হচ্ছে। অবশিষ্ট বর্জ্য সাগরে চলে যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে ফেলতে এখন কস্তুরাঘাট এলাকার নদীর বুকে ৪০-৫০ ফুট উঁচু বর্জ্যের পাহাড় জমে গেছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে পৌর কর্তৃপক্ষ এখনো সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। শহরের কোথাও ময়লা ফেলার নির্ধারিত ভাগাড় নেই।
পৌরসভার প্রধান নির্বাহী মেহেদী মোর্শেদ বলেন, শহরের অদূরে ময়লা-আবর্জনা ফেলার ডাম্পার তৈরি প্রস্তুতি চলছে। জায়গাও ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু নানা কারণে হয়ে উঠছে না।