
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বাণীগ্রাম বাজারের পাশ দিয়ে গেলে সড়কের পশ্চিম দিকে চোখে পড়বে একটি পরিত্যক্ত মন্দির। চার গম্বুজ এবং একটি বড় কেন্দ্রীয় গম্বুজ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্থাপনাটি শুধু স্থাপত্যের নিদর্শন নয়, এটি সাক্ষী হয়ে আছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শিক্ষার উন্মেষের।
এই মন্দির থেকেই ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করেছিল বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চবিদ্যালয়। শুরুর বছর ছিল মাত্র সাতজন ছাত্র, দুজন শিক্ষক। মন্দিরটির চারপাশে বেড়া দিয়ে বানানো হয় শ্রেণিকক্ষ, বারান্দায় চলত পাঠদান। কয়েক বছর পর বিদ্যালয় নতুন ভবনে স্থানান্তর হলেও, এই মন্দিরই হয়ে ওঠে আবাসিক ছাত্রাবাস—যেখানে শতবর্ষজুড়ে বসবাস ও পড়াশোনা করেছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী।
জানা গেছে আড়াই শ বছরের পুরোনো শিখ মন্দিরটিতে বিগত এক শ বছরের বেশি সময় কোনো প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয় না। শিখ সম্প্রদায়ের মানুষজন ওই এলাকা ছেড়ে যাওয়ায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বহু আগেই এটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। আর সেই পরিত্যক্ত ভবনেই গড়ে ওঠে বাণীগ্রাম সাধনপুর বিদ্যালয়।
যেভাবে মন্দির ভবনে বিদ্যালয়
বাঁশখালী নিয়ে রচিত বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থেও এই শিখ মন্দিরে বানীগ্রাম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জানা যায়। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ওই এলাকার এক সময়কার প্রতাপশালী জমিদার রায় পরিবারের হাতে। শিক্ষানুরাগী ও সংস্কৃতিমনা রায় পরিবারের নিজস্ব পাঠাগার ছিল। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় সেই পাঠাগারের বই আর আসবাবও দান করে দেন তারা।
রায় পরিবারের তিন ভাই গিরীন্দ্র চন্দ্র রায়, সুরেন্দ্র চন্দ্র রায় এবং নগেন্দ্র কুমার রায় এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সুরেন্দ্র চন্দ্র রায় চট্টগ্রাম জেলার অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ১৯১৭ সালে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চবিদ্যালয়ের। প্রথম বছর ছাত্র ছিল মাত্র ৭ জন আর শিক্ষক ছিলেন দুজন। ১৯১৯ সালে বিদ্যালয়টি বাঁশখালীর প্রথম মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি লাভ করে। ১৯২০ সালে দশম শ্রেণি খোলার পর এটি পূর্ণাঙ্গ উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপ নেয়। ১৯২১ সালে বিদ্যালয় থেকে প্রথমবারের মতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ওই ৭ জন অংশ নেন।
জানা গেছে, পরিত্যক্ত শিখ মন্দিরটি বিদ্যালয়ের জন্য সংস্কার করা হয়েছিল তাদের টাকায়। এর চতুর্দিকে বারান্দাও তৈরি তরা হয়েছিল। ওই সময় তাঁদের বাড়ির পাঠাগারের বহুদিনের সঞ্চিত বই ও আলমারি বিদ্যালয়ের জন্য দান করেন।
বাঁশখালীতে যে কারণে শিখ মন্দির
ইতিহাসবিদদের মতে, বাঁশখালীর বাণীগ্রামে এক সময় কিছু শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। রায় পরিবার আসার আগেই তারা এই অঞ্চলে আসেন। জনশ্রুতি আছে, বাণীগ্রামে রায় পরিবারের কাছে গুরুগোবিন্দ সিংয়ের হাতে লেখা এক কপি শিখ ধর্মগ্রন্থ 'গ্রন্থ সাহেব' ছিল এক সময়।
বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রয়াত সভাপতি খোন্দকার মোহাম্মদ ছমিউদ্দীন তাঁর একটি প্রবন্ধে লেখেন, প্রতিষ্ঠার কোনো নির্দিষ্ট সাল জানা না গেলেও ১৭৫৮ থেকে ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে ফৌজদার মহাসিং এর আমলে এ শিখ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। ফৌজদার এবং তাঁদের সহযোগী সহযাত্রীদের ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনের সুবিধার্থে শিখরা এ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রয়াত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবদুল করিমও একই রকম কথা বলেছেন। তিনি তাঁর লেখায় লিখেছেন, ‘বাণীগ্রামের রায় স্টেট অনেক প্রাচীন। বাণীগ্রাম হাইস্কুলের হোস্টেলটি মূলতঃ একটি শিখ মন্দির। এখানে শিখ সম্প্রদায়ের বসবাসের প্রমাণ আছে। শিখ ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থ সাহেব’ পাওয়া গেছে এখানে। জমিদারি প্রতিষ্ঠার আগ থেকেই শিখরা এখানে আসতেন। তাঁরাই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।’
১৯১৭ সালে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় এই শিখ মন্দিরেই। পরে বিদ্যালয় তার নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয়। মন্দিরটি হয়ে ওঠে ছাত্রাবাস। একসময় দক্ষিণ চট্টগ্রামের একমাত্র ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হতো এই মন্দির।
ওই হোস্টেল থেকে পড়াশোনা করেছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক ও সাবেক প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ, সাবেক সংসদ মোখতার আহমদ এবং মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার মো. ছমিউদ্দীন।
বিদ্যালয়ের বর্তমান পরিত্যক্ত হোস্টেলের দায়িত্বে ছিলেন শিক্ষক মো. নুরুল কাদের। তিনি ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হোস্টেল সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ‘ওই ছাত্রাবাস থেকে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরি হয়েছে।’
বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চবিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকার সম্পাদক বশির উদ্দিন কনক বলেন, ‘এই হোস্টেল শুধু ভবন নয়, আমাদের আবেগ, স্মৃতি আর ইতিহাসের অংশ। এটি ধরে রাখতে না পারলে হারিয়ে যাবে প্রজন্মের সংযোগ।’
একদা ধর্মচর্চার কেন্দ্র, পরে বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র—শিখ মন্দির এখন জরাজীর্ণ। পলেস্তারা খসে পড়ছে, লাল ইটের কঙ্কাল উঁকি দিচ্ছে দেয়ালে। মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের নিদর্শন হয়ে নিঃশব্দে সাক্ষ্য দিচ্ছে সময়ের।