দিনাজপুর শহর

দরজিপাড়ায় এবার কাজ কম

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বর্তমান মজুরিতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন দরজি। 

ঈদ সামনে রেখে কাপড় সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত কারিগরেরা। গত বুধবার রাতে দিনাজপুর শহরের মালদহপট্টি এলাকার একটি দরজির দোকানে
ছবি: প্রথম আলো

সেলাই মেশিনের পা-দানিতে দুই পা দুলছে জিয়ারুলের (৪০)। মাঝেমধ্যে বাঁ হাত রাখছেন মেশিনের ঘূর্ণমান চাকায়। খানিকটা ঝুঁকে গভীর মনযোগে শার্ট সেলাই করছেন। কী কাপড়? দামই–বা কত? কার গায়ে উঠবে এই শার্ট? এসব ভাবনার সময় নেই তাঁর।

দিন শেষে ৪টি শার্ট সেলাই করতে পারলে ৪৮০ টাকা মিলবে। সেই টাকায় হবে সংসারের বাজার। তবে কয়েক বছর ধরে দরজিপাড়ায় কাজ কমে যাওয়ায় আয় কমেছে তাঁর।

জিয়ারুল কাজ করেন দিনাজপুর শহরের মালদহপট্টি এলাকায় স্টুডেন্ট টেইলার্সে। ২০ বছর এখানেই জেন্টস কারিগর হিসেবে কাজ করছেন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আলাপচারিতায় তিনি জানান, বছর তিনেক আগেও তাঁর দৈনিক আয় ছিল ৬০০-৭০০ টাকা। এখন ৪০০ টাকার কাজ হয় না।

আগে ঈদের সময় দম ফেলার সময় থাকত না। রাত জেগে কাজ করতেন। এখন কাজ কমে গেছে। রাত সাড়ে দশটার মধ্যে কারখানা বন্ধ করে বাড়ি যান। তিনি বলেন, ‘জীবনে অন্য কোনো কাজ শিখিনি। বর্তমানে যা আয়, তা দিয়ে সংসার চালানো মুশকিল। ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। ঈদের পরে অন্যকিছু চিন্তা করতে হবে।’

মানুষের হাতে টাকা না থাকায় পোশাকের বিলাসিতাও নেই। প্রয়োজনটুকু মেটাতেই হিমশিম অবস্থা।
বৈদ্যনাথ রায়, স্টুডেন্ট টেইলার্সের মালিক

জিয়ারুলের মতো দরজির কাজ ছেড়ে অন্য কিছু করার চিন্তা করছেন অনেকে। তৈরি পোশাকের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ায় কাজের পরিমাণ কমে যাওয়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বর্তমান মজুরিতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা। বৃহস্পতিবার দিনাজপুর শহরে মালদহপট্টি, বাহাদুর বাজার, হকার্স মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, কাজের তেমন চাপ নেই দরজিদের।

মেশিনের খটখট শব্দেও ভাটা পড়েছে। প্রতিটি কারখানায় অর্ধেক মেশিন খালি পড়ে আছে। অন্তত ১৭ জন দরজির সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। দরজির কাছ করছেন ১০-৪০ বছর। গত দুই বছরে অর্ধেকেরও বেশি কারিগর দরজির কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় গেছেন। নতুন করে নারীরা যুক্ত হলেও পুরুষেরা আর আসছেন না। মালিকের ঘরে কাজ না থাকা, বয়স বেশি হওয়ায় অন্যকাজে যাওয়ার শক্তি না থাকায় কেউ কেউ হকার্স মার্কেটের আশেপাশে খোলামাঠে মেশিন নিয়ে বসেছেন। পুরোনো কাপড়, বালিশ-চাদর, প্যান্টের জিপার সেলাই করে দিন পার করছেন।

শুধু দরজিরাই নন, টেইলার্সের মালিকেরাও চিন্তিত। স্টুডেন্ট টেইলার্সের মালিক বৈদ্যনাথ রায় (৬৩) বলেন, ‘৪৩ বছর ধরে এই ব্যবসায় আছি। এবারের মতো মন্দা ব্যবসা দেখিনি। মানুষের হাতে টাকা না থাকায় পোশাকের বিলাসিতাও নেই। প্রয়োজনটুকু মেটাতেই হিমশিম অবস্থা। ঈদের সময় রাতে ঘুমানোর সময় পেতাম না। ১৫ রোজার পরে কাস্টমার ফিরিয়ে দিতে হতো। এখন এসব কথা যেন ইতিহাস। লেডিস টেইলার্স টিকে থাকলেও জেন্টস টেইলার্সের ব্যবসা খুব বেশি এগোবে না।’

দিনাজপুর শহরের টেইলার্স মালিক সমিতির সভাপতি ও ললনা টেইলার্সের স্বত্বাধিকারী আসাদুল হক বলেন, শহরে বর্তমানে ছোটবড় মিলিয়ে দেড় শতাধিক টেইলার্স রয়েছে। গত দুই বছরে অন্তত অর্ধশত দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। বড় দোকানগুলোয় গড়ে ১৫-২০ জন কারিগর কাজ করতো। এখন ছয়-আটজন কাজ করছেন। বর্তমানে যাঁরা কাজের মধ্যে রয়েছেন, অধিকাংশই নারী শ্রমিক। অনেকেরই বাড়িতে এখন সেলাই মেশিন রয়েছে। অনেক নারী বাড়িতে নিজেদের পোশাক সেলাই করেন।

বর্তমানে একটি থ্রি-পিস সেলাইয়ের খরচ ৪৫০-৯০০ টাকা। এছাড়া ব্লাউজে ৩০০-৪৫০, পেটিকোট ১০০-১৫০, বেবি ফ্রক ২০০-২৫০, মেক্সি ২০০-৩০০, গাউনের মজুরি ৬০০-৯৫০ টাকা খরচ হয়। অন্যদিকে একটি শার্ট সেলাইয়ের খরচ ৩০০-৪০০ টাকা ও প্যান্ট ৪৫০-৬০০ টাকা।

মালদহপট্টি এলাকায় অঞ্জলী বুটিকস অ্যান্ড টেইলার্সের স্বত্বাধিকারী শম্পা দাস বলেন, ‘নারীদের মধ্যে স্টিচ কাপড়ের (সেলাই করা) চাহিদা বাড়ছে। স্টিচ পোশাক কিনে দরজির দোকানে এসে ফিটিং করে নিয়ে যান। পুরুষের বেলায়ও তা–ই। তাঁর কারখানায় ৯ জন শ্রমিক কাজ করতেন। এখন আছেন ৪ জন।’

প্রতিটি থ্রি-পিস সেলাইয়ে দরজিরা মজুরি পান ১২০-১৪০ টাকা, ব্লাউজে ১১০-১৩০টাকা, পেটিকোট ৫০ টাকা, গাউন ২০০-২৩০ টাকা, ফতুয়া ১০০-১৩০ টাকা ও বেবি ফ্রকে ১৩০-১৬০ টাকা। অন্যদিকে শার্টের মজুরি ১১০-১২০ টাকা ও প্যান্ট ১৬৫-১৭০ টাকা। দিনশেষে কাজের হিসাব দিয়ে তাঁরা মালিকের কাছে টাকা নেন। সাপ্তাহিক কিংবা মাসভিত্তিতেও মজুরি নেন কেউ কেউ। তবে মজুরির বিষয়ে নিপুন টেইলার্সের মালিক খায়রুল আলম বলেন, প্রতিটি কাজে গ্রাহকের কাছে যা নেওয়া হয়, তার ২৫ শতাংশ কারিগরকে দেওয়া হয়।

বাহাদুর বাজার এলাকায় সিটি টেইলার্স এ কাজ করেন আবদুর রাজ্জাক (৪৯)। তিনি বলেন, একটা সময় ফুলটাইম কাজ করতেন। এখন বছরে চার মাস কাজ করেন। দিনে দুটি প্যান্ট বানানো যায়, বড়জোর তিনটি। শার্ট বানানো যায় চারটি। দুটি প্যান্টের মুজুরি থেকে আসে ৩৩০ টাকা।