আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দেশের বেশির ভাগ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীদের মধ্যে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন আসনে এ চিত্র ভিন্ন। এখানে দুই বড় দলের পাশাপাশি মূল লড়াইয়ে থাকবে আঞ্চলিক দলগুলোও।
স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা জানান, পাহাড়ের স্থানীয় ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে ভূমিকা রাখে আঞ্চলিক দলগুলো। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) না থাকায় এই দলগুলোর গুরুত্ব আরও বাড়বে।
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। এখানকার তিন আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। আঞ্চলিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রার্থী ঘোষণা করেনি।
দুই দলই জানিয়েছে, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে অবস্থান প্রকাশ করা হবে। তবে নির্বাচন নিয়ে তাদের প্রস্তুতি আছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন না থাকায় স্বতন্ত্র হিসেবে লড়বেন এই দুই দলের প্রার্থীরা।
আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে জেএসএসের প্রভাব তিন জেলাতে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাঙামাটিতে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে রাঙামাটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দীপংকর তালুকদারকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন জেএসএসের সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী না হলেও ৯৪ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন আসনে বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে বেশি। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক চারটি নির্বাচনে বান্দরবান আসনে কখনো বিএনপি জয়লাভ করেনি। রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে জিতেছিল শুধু ২০০১ সালে। তখন আলোচনা ছিল, আঞ্চলিক দল জেএসএসের সমর্থন থাকায় বিএনপির জয়ের পথ সহজ হয়।
আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে জেএসএসের প্রভাব তিন জেলাতে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাঙামাটিতে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে রাঙামাটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দীপংকর তালুকদারকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন জেএসএসের সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী না হলেও ৯৪ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন তিনি।
জেএসএস নির্বাচন করবে কি না এবং নির্বাচন করলে কারা প্রার্থী হবেন, তা তফসিল ঘোষণার পর চূড়ান্ত হবে। তবে নির্বাচন নিয়ে দলের ভেতর আলোচনা চলছে।—কে এস মং, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জেএসএস
অন্য আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফের প্রভাব বেশি খাগড়াছড়িতে। ২০০১ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে খাগড়াছড়ি আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা প্রসিত বিকাশ খীসা। দুই নির্বাচনেই উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়েছিলেন তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বাচনী লড়াইয়ে সক্রিয় আছেন গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রার্থীরা।
খাগড়াছড়ির মতো রাঙামাটি আসনেও বিএনপি সর্বশেষ জিতেছিল ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে জয়লাভ করা মনি স্বপন দেওয়ানকে অবশ্য এবার মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এবার বিএনপির প্রার্থী করা হয়েছে বিচারকের চাকরি (জেলা যুগ্ম জজ) ছেড়ে রাজনীতিতে আসা দীপেন দেওয়ানকে। কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-ধর্মবিষয়ক সম্পাদক দীপেন দেওয়ান বলেন, ধানের শীষ প্রতীকের বিজয়ের জন্য বিএনপির সবাই ঐক্যবদ্ধ। দলে কোনো বিভেদ নেই।
রাঙামাটিতে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হয়েছেন আইনজীবী মোখতার আহম্মদ। তিনি বলেন, এবারের নির্বাচন নিয়ে তাঁদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রয়েছে। রাঙামাটিতে বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে নির্বাচনী লড়াইয়ে আছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জুঁই চাকমা। এনসিপির মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করছেন বিপিন জ্যোতি চাকমা, শহিদুল ইসলাম খান ও প্রিয় চাকমা।
খাগড়াছড়ি আসনে বিএনপি সর্বশেষ জয়লাভ করেছিল ২০০১ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে জয়ী জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়াকে এবারও প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে লড়বেন ইয়াকুব আলী চৌধুরী।
বিএনপির প্রার্থী আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে, নিজে প্রতিটি উপজেলায় যাচ্ছেন, সভা-সমাবেশ করছেন। তবে একটি পক্ষ দুর্গম এলাকায় বিএনপির সমর্থকদের কাজ করতে বাধা দিচ্ছে।
জামায়াতের প্রার্থী ইয়াকুব আলী চৌধুরী বলেন, পাহাড়ের প্রতিটি সম্প্রদায়ের কাছে যাচ্ছেন। খাগড়াছড়ির মানুষ এমন কাউকে এই আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে চান, যিনি চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে থাকবেন।
এই দুই বড় দলের বাইরে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক ও খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সদস্য মনজিলা সুলতানা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই আসনে বিএনপির প্রার্থী সর্বশেষ জয়লাভ করেছিলেন ১৯৯৬ সালের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে। শক্ত সাংগঠনিক অবস্থান থাকলেও দলীয় কোন্দলের কারণে এই আসনে বিএনপি বারবার পরাজিত হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। দলীয় প্রার্থী নিয়ে এবারও অভ্যন্তরীণ বিরোধ রয়েছে।
এবার বিএনপির হয়ে লড়বেন বান্দরবান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাচিংপ্রু জেরী। বিএনপির আরেক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ম্যামাচিং ও সদস্যসচিব জাবেদ রেজা।
এই আসনের জামায়াতের প্রার্থী হয়েছেন দলের বান্দরবান জেলার নায়েবে আমির আইনজীবী আবুল কালাম। এ ছাড়া নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছেন গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়কারী রিপন চক্রবর্তী। এনসিপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপ্রত্যাশী মংসাপ্রু চৌধুরী।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে অন্তত চারটি আঞ্চলিক দল সক্রিয় আছে। এগুলো হলো জেএসএস, ইউপিডিএফ, জেএসএস (এম এন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। বড় দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াত আগাম প্রচারণা শুরু করলেও এখন পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণায় নেই আঞ্চলিক দলগুলো।
জেএসএসের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কে এস মং প্রথম আলোকে বলেন, জেএসএস নির্বাচন করবে কি না এবং নির্বাচন করলে কারা প্রার্থী হবেন, তা তফসিল ঘোষণার পর চূড়ান্ত হবে। তবে নির্বাচন নিয়ে দলের ভেতর আলোচনা চলছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনে রাঙামাটিতে সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার এবং বান্দরবানে কে এস মংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সম্ভাবনা রয়েছে। খাগড়াছড়িতে প্রার্থী দেওয়ার সম্ভাবনা কম।
২০০১ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে খাগড়াছড়ি আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল ইউপিডিএফ। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন ইউপিডিএফের প্রতিষ্ঠাতা প্রসিত বিকাশ খীসা। এবারও তাঁর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা আছে।
জেএসএস ও ইউপিডিএফ ছাড়া অন্য দুই আঞ্চলিক দলের মধ্যে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নির্বাচনে অংশ নেবে না। সাংগঠনিক সম্পাদক অমর জ্যোতি চাকমা বলেন, তফসিল ঘোষণার পর যোগ্য দেখে একজনকে দল থেকে সমর্থন দেওয়া হবে।
ইউপিডিএফের সংগঠক অংগ্য মারমা প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যেকোনো নির্বাচনে ইউপিডিএফ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। আগামী নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম হবে না।