মেঘনা নদীতে ইলিশ মাছ শিকার করছেন জেলেরা। সম্প্রতি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার নরসিংহপুর এলাকায়
মেঘনা নদীতে ইলিশ মাছ শিকার করছেন জেলেরা। সম্প্রতি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার নরসিংহপুর এলাকায়

১০ বছর হঠাৎ কমল ইলিশের উৎপাদন, দিশেহারা শরীয়তপুরের জেলেরা

শরীয়তপুরের নদ-নদীতে কয়েক বছর ধরে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছিল। হঠাৎ চলতি বছর ইলিশের উৎপাদন কমেছে। গত বছরের চেয়ে যা ২ হাজার ৪১ মেট্রিক টন কম। জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না আগের মতো ইলিশ। হাটবাজারেও খুব বেশি দেখা মেলে না জাতীয় মাছের। ইলিশ শিকারের সঙ্গে জড়িত জেলেদের মুখেও নেই হাসি। সব সময় অভাব লেগে আছে তাঁদের সংসারে।

শরীয়তপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, শরীয়তপুরের ওপর দিয়ে পদ্মা ও মেঘনা নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদী দুটির ৮০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জেলেরা ইলিশ মাছ শিকার করেন। জেলায় ১৫ হাজার জেলে ইলিশ মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ইলিশের ভরা মৌসুম জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। অক্টোবর মাসে ২২ দিন চলে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান। তখন নদীতে সব ধরনের মাছ শিকার নিষিদ্ধ থাকে। এরপর নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা শিকার নিষিদ্ধ। ওই সময়ে জেলেরা ৯ ইঞ্চির ছোট ইলিশ শিকার করতে পারেন না। এরপর মার্চ-এপ্রিল ইলিশের অভয়ারণ্যে মাছ শিকার বন্ধ থাকে। এভাবে বছরের অন্তত ১০ মাস নদীতে ইলিশ শিকারের ওপর বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ থাকে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেলেরা বিনা বাধায় ইলিশ শিকার করতে পারেন।

মৎস্য কার্যালয় ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময়কে উৎপাদনের বছর হিসেবে বিবেচনা করে। তারা নদীর তীরবর্তী ইলিশের আড়ত ও মাছ শিকার করা জেলে নৌকা থেকে প্রতি মাসের অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সময় দুই দিন করে চার দিন মাছ আহরণের হিসাব নেয়। এরপর তা দিয়ে সারা মাসের মাছের উৎপাদনের গড় হিসাব বের করেন। হিসাব অনুযায়ী, গত ১০ বছর ধরে প্রতিবছর শরীয়তপুরে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। ২০১৫ সালে জেলায় ইলিশের উৎপাদন হয়েছিল ২ হাজার মেট্রিক টন, ২০১৬ সালে ২ হাজার ১৭০ মেট্রিক টন, ২০১৭ সালে ২ হাজার ১৭৫ মেট্রিক টন, ২০১৮ সালে ২ হাজার ১৮০ মেট্রিক টন, ২০১৯ সালে ২ হাজার ২১০ মেট্রিক টন, ২০২০ সালে ৩ হাজার ৮৫০ মেট্রিক টন, ২০২১ সালে ৪ হাজার ৫৮০ মেট্রিক টন, ২০২২ সাল ৫ হাজার ৬৪৩ মেট্রিক টন, ২০২৩ সালে ৫ হাজার ৯০১ মেট্রিক টন এবং ২০২৪ সালে ৬ হাজার ৪২ মেট্রিক টন। চলতি বছরে (৩০ জুন) ৪ হাজার ১ মেট্রিক টন ইলিশের উৎপাদন হয়েছে। ১০ বছর ধরে প্রতিবছর উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও এ বছর তা কমেছে। গত বছর হতে এ বছর উৎপাদন কমেছে ২ হাজার ৪১ মেট্রিক টন।

মেঘনা নদীতে ইলিশ মাছ শিকারের পর জেলেরা নদীর তীরে বসে জাল মেরামত করছেন। সম্প্রতি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার নরসিংহপুর এলাকায়

শরীয়তপুর জেলার পদ্মা ও মেঘনার ৮০ কিলোমিটার জুড়েই কমবেশি ইলিশের বিচরণ আছে। এর মধ্যে নড়িয়ার সুরেশ্বর থেকে গোসাইরহাটের কোদালপুর পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার এলাকা ‘ইলিশের বিশেষ এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে মৎস্য বিভাগ। বর্তমানে ওই এলাকায় জেলেরা সার্বক্ষণিক ইলিশ মাছ শিকার করেন। জেলার জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের অন্তত ৬০টি গ্রামের বাসিন্দারা পদ্মা ও মেঘনা নদীতে ইলিশ মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

ভেদরগঞ্জের কাচিকাটা এলাকার জেলে ইয়াছিন সরকারের বয়স ৫৫ বছর। ৪০ বছর ধরে পদ্মা নদীতে ইলিশ মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে সংসার চালতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দাদার হাত ধরে বাবা নদীতে মাছ শিকারে নেমেছেন। বাবার হাত ধরে আমি নেমেছি। একটি ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চারজন সহকারী নিয়ে মাছ শিকার করি। বছরের ১০ মাস নানা ধরনের বাধানিষেধের মধ্যে মাছ শিকার করতে হয়। নদীতে আগের মতো ইলিশ পাওয়া যায় না। কোনো সময় এমন হয় দিন-রাতেও একটি মাছ পাই না। তখন তেল খরচ ও শ্রমিকদের মজুরি পকেট থেকে ব্যয় করতে হয়। এখন যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে সংসার চালাতে পারছি না। নৌকা মেরামত, জাল মেরামত ও সহকারীদের টাকা পরিশোধ করার পর হাতে আর টাকা থাকে না।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব প্রথম আলোকে বলেন, গত ১০ বছর ধরে ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। চলতি বছর মাছের উৎপাদন কমেছে। এ বছর দামও অন্যান্য বছরের তুলনায় একটু বেশি। কী কী কারণে ইলিশের উৎপাদন কমছে, তা চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করা হবে।

নড়িয়ার চরআত্রা এলাকার জেলে দিদারুল ইসলামের পরিবারের সদস্য ছয়জন। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে দুই সন্তান পড়ালেখা করছে। সন্তানদের পড়ালেখা ও সংসারের সারা বছরের খরচ করতে তার প্রয়োজন তিন লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা। প্রতিবছর মাছ শিকারের জন্য নৌকা ও জাল মেরামতে প্রয়োজন আরও এক লাখ টাকা। কিন্তু দিদারুলের এখন আর সেই আয় নেই। তাই দিদারুল দাদন নিয়ে সংসার চালান, নৌকা-জাল মেরামত করেন।

দিদারুল প্রথম আলোকে বলেন, দিনরাত ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে নদীতে থাকতে হয়। কখনো নদীতে না গেলে আড়ত মালিক (যার কাছ থেকে দাদন নেওয়া) চাপ সৃষ্টি করেন। মাছ শিকারের পর তা অন্যত্র বিক্রির স্বাধীনতাও নেই। সঙ্গে সঙ্গে আড়তদারের কাছে নিয়ে আসতে হয়। তিনি যা বিক্রি করেন তা থেকে তাঁর কমিশন রেখে বাকি টাকা দেন। এভাবে আর চলতে পারছেন না। নদীতে মাছ নেই, এর ওপর আবার আড়তদারের চাপ।

নড়িয়ার সুরেশ্বর মাছঘাটের ব্যবসায়ী মোকলেছ মোল্যা প্রথম আলোকে বলেন, সুরেশ্বর ঘাট জেলার একটি শীর্ষ ইলিশ মাছ বিক্রির বাজার। দুই বছর ধরে জেলেদের জালে তেমন ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে না। নদীতে খুবই কম পরিমাণ মাছ পাওয়া যাচ্ছে। যা পাওয়া যায়, তার অনেক দাম। ৮০০ থেকে ১ কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছ বর্তমানে ২ হাজার ২০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। এর চেয়ে ছোট আকারের মাছ ৮০০ টাকা থেকে ১৮০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। ইলিশ এখন ধনীদের খাবার হয়েছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ এখন আর ইলিশ মাছ কিনতে পারেন না।