
‘একটু পরই আমরা ঢুকে যাব রাতারগুল জলাবনে। আপনারা পানিতে ভাসতে ভাসতে দেখতে পাবেন গাছগাছালির অপূর্ব সৌন্দর্য। ভাগ্য ভালো থাকলে পাখির ওড়াউড়ি আর মাছের লাফালাফিও দেখতে পাবেন।’ ভরাট কণ্ঠে একনাগাড়ে প্রতিদিন পর্যটকদের উদ্দেশে এভাবে বলতে থাকেন মাঝি মো. সিফত উল্লাহ।
মিঠাপানির জলাবন রাতারগুলে পর্যটকদের আনা-নেওয়া করেন সিফত উল্লাহ। এখানকার আরও অনেক মাঝির মতোই পঞ্চাশ পেরোনো সিফত নৌকায় করে পর্যটকদের বনের ভেতরে নিয়ে যান আর চারপাশ ঘুরিয়ে দেখান। আর এ সময়েই তাঁর ভরাট কণ্ঠের এ বার্তা শুনতে পান পর্যটকেরা। পানিতে ভাসতে থাকা হিজল, করচ আর মূর্তাগাছের সবুজ স্নিগ্ধতার সঙ্গে তিনি পর্যটকদের পরিচয় করিয়ে দেন। ফাঁকে ফাঁকে গজলও গেয়ে শোনান।
সিলেট নগরের কদমতলী বাস টার্মিনাল থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে গোয়াইনঘাট উপজেলায় রাতারগুলের অবস্থান। বন বিভাগ ১৯৭৩ সালে বনের ৫০৪ দশমিক ৫০ একর আয়তনের বনটিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করে। হাওর ও নদীবেষ্টিত এ বন বর্ষাকালেই তার অনিন্দ্য সৌন্দর্যে ভ্রমণপিপাসুদের টেনে আনে। তখন নৌকায় করে বনভ্রমণই প্রধান আকর্ষণ।
কয়েক দিন আগে এক দুপুরে রাতারগুলে গিয়ে সিফত উল্লাহর দেখা মেলে। তাঁর নৌকায় জলাবন ঘুরতে গিয়ে জানা হয় তাঁর জীবনের গল্প। নৌকায় বসে গল্প করতে করতে তিনি জানালেন, নৌকা চালিয়েই সংসার চলে তাঁর। রাতারগুল তাঁর কাছে বেঁচে থাকার মূল আশ্রয়। দিনের প্রায় পুরোটা সময়ই তাঁকে জলাবনে কাটাতে হয়। রাতারগুল তাঁর কাছে আরেকটি সংসারের মতো।
সিফত উল্লাহর সংসারে স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। এক ছেলে তাঁর মতোই রাতারগুলের মাঝি। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। সিফত বলেন, যাত্রী পরিবহনে মাঝিরা নির্ধারিত সিরিয়াল অনুযায়ী পালা করে জলাবনে পর্যটক নিয়ে যান। তিনি গড়ে এক থেকে দুইবার পর্যটক পরিবহন করতে পারেন। আবার পর্যটক বেশি হলে তা কোনো কোনোদিন দ্বিগুণ হয়। প্রতি ট্রিপে তিনি নৌকায় ৮–১০ জন যাত্রী নেন। প্রতি ট্রিপে নৌকা ভাড়া ৭৫০ টাকা। তবে এ আয় থেকে বন বিভাগকে দিতে হয় ১১৫ টাকা।
সিফত বলেন, ‘আয় সামান্য। আল্লায় কুনুরকমে চালাইন। তবে পর্যটকদের আমি গজল শুনাই। দুইটা গজল জানি, দুইটাই শুনাই। এই গজল শুইন্যা কেউ কেউ আমারে বকশিশ দেন। এতে আরও কিছুটা আয়-উপার্জন হয়।’ কথা শেষে গজল গাইতে শুরু করেন, ‘ভুলি না, ভুলিতে পারি না সোনার মদিনা...’।
গজল শেষে আবার কথা বলা শুরু করেন সিফত। তিনি বলেন, রাতারগুল এখন দেশ-বিদেশে সুপরিচিত। এখানে প্রতিদিন অনেক মানুষ ভ্রমণে আসেন। পর্যটনের কারণে স্থানীয় গ্রামবাসীর আয়ের উৎসও তৈরি হয়েছে। তাই বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষায় গ্রামবাসী সচেতন। কেউ যেন রাতারগুলের পরিবেশ ও প্রকৃতি বিনষ্ট করতে না পারে, সে জন্য স্থানীয়দের সজাগ দৃষ্টি থাকে সব সময়।