
পাহাড়ে অবৈধ বসতির প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে কোনো আধুনিক বা বেসরকারি জরিপ নেই।
চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বসতি নিয়ে সরকারি তালিকা ও বাস্তব পরিস্থিতির মিল নেই। জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, নগরের ২৬টি পাহাড়ে সাত হাজারের বেশি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। স্থানীয় সূত্র ও সিটি করপোরেশনের মতে, এই সংখ্যা অবাস্তব। প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েক গুণ বেশি।
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সভায় জানিয়েছেন, শুধু মতিঝরনা ও বাটালি পাহাড়েই প্রায় ১০ হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। স্থানীয় সূত্র বলছে, আকবরশাহ থানার পাঁচটি পাহাড়েও আরও প্রায় ১০ হাজার পরিবার বসবাস করছে ঝুঁকি নিয়ে।
তবে পাহাড়ে অবৈধ বসতির প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে কোনো আধুনিক বা বেসরকারি জরিপ নেই। সর্বশেষ ২০২০ সালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তালিকা হালনাগাদ করা হয়। তখন ২৬টি পাহাড়ে ৬ হাজার ৫৫৮টি পরিবারের বসবাসের তথ্য দেওয়া হয়। পরে যুক্ত হয় ৯১৪ পরিবার। এর মধ্যে ১১টি পাহাড় ব্যক্তিমালিকানাধীন, বাকি ১৫টি রেলওয়ে, গণপূর্ত, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের অধীন।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ১২তম সভায় মাত্র ৬৬৬টি পরিবারের অবৈধভাবে বসবাসের তথ্য উল্লেখ ছিল। এর পর থেকে প্রতিবছরই পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীর সংখ্যা বেড়েছে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসচিব মো. সাদি উর রহিম জাদিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০২০ সালের পর চলতি বছর নতুন করে আরও ৯১৪টি পরিবারকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি। নিম্ন আয়ের মানুষ এসব এলাকায় বসতি গড়ছেন।’
তবে সরকারি তালিকার বাইরেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দা ও কর্মকর্তারা। মতিঝরনা, বাটালি পাহাড়, আকবরশাহর ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিল, জিয়ানগর, বিজয়নগর ও মধ্যমনগর—এই এলাকাগুলোতে বসতি সবচেয়ে বেশি।
চলতি বছরের ২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ৩০তম সভায় সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মতিঝরনা ও বাটালি পাহাড় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই দুই পাহাড়ে প্রায় ১০ হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।’
প্রথম আলোকে তিনি আরও বলেন, ‘এই দুই পাহাড়ে কমপক্ষে ৫০ ভাগ মানুষ অবৈধভাবে বসবাস করছে। দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে। নানা এলাকা থেকে মানুষ এসে এখানে বসতি গড়ে তুলছে। পাহাড় রক্ষায় মালিক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তরগুলোর সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার।’
সরেজমিন দেখা গেছে, আকবরশাহ এলাকার রেলওয়ের পাহাড়ে নতুন বসতি গড়ে উঠছে। ৯ জুলাই ১ নম্বর ঝিল পাহাড়ে গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের পাশে নতুন কাঁচা ও সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব এলাকায় জমি কেনাবেচাও হয়, রয়েছে ‘সমিতি’ও।
পাহাড়ের বাসিন্দা টুনি আকতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন বছর আগে দুই কামরার একটি টিনশেড ঘর তুলতে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। স্বামী রিকশা চালান। কুমিল্লা থেকে এসেছি আমরা। এখন বৃষ্টির কারণে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছি।’
১ নম্বর ঝিল সমাজকল্যাণ সমিতির সহসভাপতি মো. মনির জানান, ওই পাহাড়ে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার বসবাস করছে। ২ ও ৩ নম্বর ঝিলে আরও ১৫ হাজার পরিবার এবং জিয়া নগর, বিজয়নগর, মধ্যম নগরে আছে আরও প্রায় ১০ হাজার পরিবার।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর মতে, এসব এলাকার অন্তত ১০ হাজার পরিবার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। তবে এ বিষয়ে কোনো বেসরকারি জরিপ নেই।
চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সাবেক সভাপতি ও নগর–পরিকল্পনাবিদ দেলোয়ার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০৭ সালের পাহাড়ধসের পর থেকে প্রতিবছর আলোচনা হয়, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। এখন যে তালিকা জেলা প্রশাসন দিচ্ছে, সেটি অবাস্তব। শুধু লালখান বাজার এলাকার পাহাড়গুলোতেই ১৫ হাজারের বেশি পরিবার রয়েছে।’
দেলোয়ার মজুমদার আরও বলেন, ‘এগুলো সরকারি পাহাড় বেহাত করার কৌশল। আগেভাগে যাঁরা বসতি গড়েছেন, তাঁদের টোকেন দিলে, পরে যাঁরা এসেছেন তাঁদের চিহ্নিত করা সহজ হতো। কিন্তু কোনো দপ্তরই পাহাড় দখলমুক্ত করতে আগ্রহী নয়।’
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালের পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। এরপর গঠিত তদন্ত কমিটি পাহাড় রক্ষায় ৩৬টি সুপারিশ করেছিল। তবে বাস্তবে কার্যকর পদক্ষেপ তেমন দেখা যায়নি।