‘এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই না, যেখানে শিক্ষার্থীর জীবন অনিরাপদ’

র‍্যাগিংয়ের শিকার হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিয়াদ হোসেন ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাচ্ছেন
ছবি: সংগৃহীত

‘আমি আর এখানে পড়ব না। এমন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়তে চাই না, যেখানে একজন শিক্ষার্থীর জীবন নিরাপদ নয়। তাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি চলে যাওয়ার। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগিংয়ের মতো মধ্যযুগীয় বর্বর নির্যাতন বন্ধ এবং স্থাপত্য বিভাগে আমলা-কামলা সম্পর্ক বাতিল করে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সুষ্ঠু, স্বাভাবিক জ্ঞানচর্চা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’

দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর গত বুধবার দুই পৃষ্ঠার একটি চিঠিতে কথাগুলো লিখেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিয়াদ হোসেন। তিনি প্রকৌশল অনুষদের স্থাপত্য বিভাগের প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী।

বিভাগের কতিপয় জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীর মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বুধবার রাতে দিনাজপুর ত্যাগ করে তিনি ঢাকায় যান। এর আগে ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, ডিন বরাবর লিখিতভাবে নির্যাতনের কথা জানিয়েছিলেন রিয়াদ।

রিয়াদের বাবা মফিজুর রহমান পরিবার নিয়ে ঢাকার মহাখালীর কড়াইল এলাকায় থাকেন। তাঁর বাবা ঢাকার গুলশান আবাসিক এলাকার একটি বাসায় নিরাপত্তাপ্রহরী হিসেবে চাকরি করেন। ঢাকার আইপি এইচ স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হন রিয়াদ।

রেজিস্ট্রার বরাবর পাঠানো চিঠিতে রিয়াদ লেখেন, ২৯ জানুয়ারি বিভাগের ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াজেদ ভবনের তৃতীয় তলার ৩৩৬ নম্বর কক্ষে ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ডাকেন। প্রায় ১ ঘণ্টা ২৫ মিনিট তাঁদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। কান ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা, ওঠবস করাসহ মিলিটারি ভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। রিয়াদ এর প্রতিবাদ করলে তাঁর গলা টিপে ধরেন একজন। খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করেন। রাত ১০টায় বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীরা রিয়াদকে বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন বাঁশেরহাট এলাকার একটি ছাত্রাবাসে ডেকে পাঠান। পরদিন শহরের সুইহারি এলাকার পরিচিত এক বড় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দেখা করতে গেলে তাঁরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগে র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে প্রশাসন কঠোর হলেও স্থাপত্য বিভাগে এটা মানা হয় না। এখানে সিনিয়র-জুনিয়রদের সম্পর্ক আমলা-কামলা। একজন শিক্ষার্থী যদি বড় ভাইদের কথার অবাধ্য হন, তাহলে তাঁকে অন্য শিক্ষার্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে।

চিঠিতে রিয়াদ আরও বলেন, বিভাগে ক্লাসের নির্দিষ্ট কোনো রুটিন অনুসরণ হয় না। বিষয়টি বিভাগের শিক্ষকদের জানালে শিক্ষকেরা জানান, এখানে আমলা-কামলা প্রথা স্বাভাবিক (সিনিয়ররা আমলা আর জুনিয়ররা কামলা)। এ প্রথা মেনে নিয়ে সহনশীল ও ধৈর্যশীল হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় তাঁকে। পরে রিয়াদ ক্লাসে অংশ নেন। তবে সিনিয়রদের বিষয়ে প্রতিবাদ করায় তাঁর ব্যাচের বন্ধুদের থেকেও বিচ্ছিন্ন থাকতে হয় রিয়াদকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থাপত্য বিভাগের প্রথম সেমিস্টারের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, ‘বহু আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছি। বড় ভাইদের কাছে স্নেহময় আচরণ পাব, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শুরুতেই বড় ভাইদের এমন আচরণ আমাদের ভীত করে তুলছে। হয়তো ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এর মধ্যে কেউ কেউ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। রিয়াদ বিষয়গুলোকে মেনে নিতে পারছিল না।’

রিয়াদের অভিযোগের বিষয়ে ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রাফসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক দিনই আমাদের কথা হয়েছে। কিন্তু কী কারণে সে এ ধরনের অভিযোগ করেছে, আমরা বুঝতে পারছি না।’

স্থাপত্য বিভাগের প্রধান আবু তোয়াব শাহরিয়ার বলেন, ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁকে বোঝানো হয়েছে সিনিয়রদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ শিখতে হয়। পরে বিভাগের অন্য শিক্ষার্থীদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। গতকাল শুনেছেন, ওই শিক্ষার্থী বাড়িতে চলে গেছেন। তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাঁকে আসতে বলা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মামুনুর রশিদ বলেন, ২৯ জানুয়ারির ঘটনায় ওই শিক্ষার্থীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের সতর্ক করা হয়েছে। আজ উপাচার্যের নির্দেশে অধ্যাপক বিকাশ চন্দ্র সরকারকে প্রধান করে ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীকে কেউ উসকানি দিয়ে বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিককালে র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৬ শিক্ষার্থীকে শোকজ করে তাঁদের অভিভাবককে চিঠি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।