
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের কৃষক তৈয়বুর রহমান (৪৮)। তিনি আম, আতা, পেয়ারা, পেঁপে, কচু, আদা, কলা, কুলসহ অন্তত ১০ ধরনের ফসল ফলিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তাঁর দেখাদেখি এলাকায় কৃষিতে উৎসাহ বেড়েছে।
তৈয়বুরের এক বিঘা জমিতে পেঁপের বাগান। তিন থেকে চার ফুট উচ্চতার প্রতিটি গাছেই পেঁপে ধরেছে। পেঁপেগাছের ফাঁকে নির্দিষ্ট দূরত্বে লাগানো হয়েছে উচ্চফলনশীল আতাগাছ। ৪০০ মিটার দূরে প্রায় দেড় বিঘা জমিতে লাগানো হয়েছে ‘লতিরাজ কচু’। আর এক কিলোমিটার দূরে বিলের দুই প্রান্তে নানা জাতের আম-পেয়ারার বাগান। বাগানে গাছের ফাঁকে ফাঁকে দুই হাজার বস্তায় চাষ হচ্ছে আদা। এক ফসলের মাঝে সাথি ফসল চাষ করে দেখেছেন লাভের মুখ।
দৌলতপুর গ্রামের আকবর আলীর ছেলে কৃষক তৈয়বুর রহমান। ফুলবাড়ী শহরে কেব্ল নেটওয়ার্ক ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের ব্যবসা আছে তাঁর। উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন। এরপর আর পড়ালেখা এগোয়নি। চার বছর ধরে মন দিয়েছেন কৃষিতে। ইতিমধ্যে পৈতৃক সাত একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করে সাফল্য পেয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘সঠিক পরিকল্পনা ও পরিশ্রম করতে পারলে কৃষিকে লাভজনক করা যায়। সবকিছু ছেড়ে কৃষিতে মন দিয়েছি। কৃষিকাজে আনন্দও আছে।’
সম্প্রতি দৌলতপুরের ন্যাটারবিল–সংলগ্ন এলাকায় তৈয়বুরের খামারে গিয়ে দেখা যায়, কচুখেতে শ্রমিকদের সঙ্গে লতি তোলার কাজ করছিলেন তিনি। আলাপচারিতায় জানান, চলতি বছরের জানুয়ারির শেষে দেড় বিঘা জমিতে লতিরাজ জাতের কচু লাগিয়েছেন। জয়পুরহাট থেকে বীজ এনেছেন। কচুতে সব মিলিয়ে তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। সপ্তাহে দুই দিন লতি তুলে বিক্রি করছেন। এরই মধ্যে ৭০ হাজার টাকার লতি বিক্রি করেছেন। বিক্রির অপেক্ষায় আছে মাটির নিচে থাকা সোলাকচু, কচুর ফুল ও চারা। সব মিলিয়ে কচু থেকে খরচ বাদেও দেড় লাখ টাকা লাভের আশা তাঁর।
পাশেই প্রায় এক বিঘা জমিতে ‘টপলেডি’ জাতের পেঁপের বাগান। প্রতিটি গাছে ফল ধরেছে। ইতিমধ্যে বিক্রিও শুরু করেছেন। তৈয়বুর জানান, প্রতিটি গাছে গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত খরচ আছে। সেখানে সবকিছু ঠিক থাকলে প্রায় ৩ লাখ টাকার শুধু পেঁপেই বিক্রি করবেন। পাশাপাশি যখন পেঁপেগাছ কেটে ফেলার সময় হবে, তত দিনে আতা বা শরিফার গাছ বড় হয়ে যাবে।
তৈয়বুর বাড়ির পাশে প্রায় দুই একর জায়গায় করেছেন আম ও পেয়ারার বাগান। সেখানে লাগানো হয়েছে বারি-৪, গৌড়মতি, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, কিউজাই, মিয়াজাকি, চিয়াংমাই, ডগমাইসহ কয়েক প্রজাতির আম। ইতিমধ্যে আম ও পেয়ারায় কার্বন ব্যাগ পরানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বাগানের বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর। গতবার ৬৫ হাজার টাকার আম বিক্রি হয়েছে। এবারও ফলন ভালো হয়েছে। আমের সব কটি জাতই লেট ভ্যারাইটি। তবে বাগানের ভেতরে দুই হাজার বস্তায় আদা ও হলুদ লাগিয়েছি। এর থেকেও ভালো টাকা আসবে।’
শুধু তা–ই নয়, ৩০ শতাংশ জমিতে মালভোগ কলা, ২০০টি আপেলকুলগাছের বাগান করেছেন তৈয়বুর। বাড়িতে আটটি দেশি গরু নিয়ে শুরু করেছেন খামার। বাগানের পাশেই কম্পোস্ট সারের হাউস তৈরি করেছেন। তিনি বলেন, ‘আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার ও নতুন নতুন ফসলের জাত সম্পর্কে জানা এবং কৃষিকাজে সফল হওয়া এখন অনেক সহজ। কৃষি বিভাগের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াতেও কৃষিবিষয়ক অনেক পরামর্শ পাওয়া যায়। এলাকার ২৩ জন নতুন কৃষি উদ্যোক্তাকে নিয়ে একটি গ্রুপ করেছি। সেখানে সবাই মিলে বিভিন্ন সমস্যা আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করি।’
তৈয়বুরকে দেখে কৃষিকাজে আগ্রহী ব্যক্তিদের একজন দৌলতপুর গ্রামের নুরবানু। তিনি বলেন, ৩০ শতাংশ জমিতে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় ফসলের বাগান করেছেন। সেখানে ২০০টি বস্তায় আদাও লাগিয়েছেন। ভার্মিকম্পোস্ট করার জন্য হাউস বানিয়েছেন।
কৃষক তৈয়বুর রহমানের বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুম্মান আক্তার বলেন, ‘তিনি উপজেলার একজন অগ্রগামী ও আধুনিক কৃষক। তাঁর কৃষি প্রজেক্টগুলো সম্পর্কে জানি। তিনি একটি ফসলের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে আরেকটি ফসল আবাদ করেন। এতে করে ভূমির সঠিক ব্যবহার হয়, তিনি আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন। কৃষি বিভাগ তাঁকে বিভিন্ন পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।’