
কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ মহেশখালীর মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকা এখন দর্শনার্থীদের পদভারে মুখর। তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে নির্মিত হচ্ছে দেশের গভীর সমুদ্রবন্দর। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে যাতায়াতের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন সড়ক। সড়কটি নির্মাণ করতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় করা হয়েছে ৪৩৭ কোটি টাকা। বিপুল এই নির্মাণ ব্যয়ের কারণে সড়কটিকে ‘সোনায় মোড়ানো’ বলে মন্তব্য করেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের এক উপদেষ্টা। মহেশখালীতে বেড়াতে আসা পর্যটকেরা একবার এই সড়কে আসেন। ছবি তোলেন, ভিডিও ধারণ করেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, কয়েক শ দর্শনার্থী সড়কের বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে ছবি তুলছেন। কেউ কেউ আড্ডা-গল্পে সময় পার করছেন। তবে বেশির ভাগ দর্শনার্থীর ভিড় দেখা গেছে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান ফটকে। তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে যাতায়াতের জন্য রাজঘাট অংশে কুহেলীয়া নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে ৮৯৫ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু। সেতু থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত সম্প্রসারিত দুই লেনের সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার সড়কে পথচারীদের হাঁটার রাস্তা ও একাধিক সেতু-কালভার্ট রয়েছে। পুরো সড়কটি দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজানো হয়েছে।
সন্ধ্যায় সড়কের দুই পাশ এবং সেতুতে বাতি জ্বলে উঠলে সমুদ্র উপকূলীয় দ্বীপটির চেহারা পাল্টে যায়। আলোকিত এই সড়কের সৌন্দর্যের টানে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা।
দেশে এত দিন সবচেয়ে ব্যয়বহুল মহাসড়ক ছিল ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত সম্প্রসারিত এক্সপ্রেসওয়ে। সওজের অধীনে ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই মহাসড়ক নির্মাণে ব্যয় করা হয় ১১ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০১ কোটি টাকা। আর মাতারবাড়ী সড়ক প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের দ্বিগুণের বেশি। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, জমি অধিগ্রহণ, নির্মাণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া এবং সমুদ্র উপকূলের দুর্গম এলাকা হওয়ায় সড়কটি নির্মাণে ব্যয়ও বেড়েছে।
মাতারবাড়ী সড়কে কথা হয় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মহেশখালী উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কর সিদ্দিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, কুহেলীয়া নদীর ওপর দৃষ্টিনন্দন সেতু এবং সড়ক পেয়ে মাতারবাড়ীর কিছু মানুষ লাভবান হলেও অনেকে হতাশ। কারণ, সড়কটি নির্মাণ করতে গিয়ে কুহেলীয়া নদী ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। পলি ও বর্জ্য জমে নদীর অন্তত ১০ কিলোমিটার ভরাট হয়ে গেছে। তাতে মাতারবাড়ীর অন্তত এক হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়েছেন। মাতারবাড়ীর পশ্চিম পাশে সমুদ্র উপকূলে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দরসহ মেগা প্রকল্প নির্মাণ করে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিলেও পূর্ব-দক্ষিণ ও উত্তর পাশে ২০-২৫ হাজার মানুষ প্লাবনের ঝুঁকিতে (ভাঙা বেড়িবাঁধ) পড়েছে। কুহেলীয়া নদীর তীর ভরাট করে সড়ক নির্মাণ বন্ধ রাখতে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন করেছিল। কিন্তু কাজ থেমে থাকেনি।
একই ধরনের মন্তব্য করে পরিবেশবিষয়ক বেসরকারি সংগঠন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা’ (ধরা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, কুহেলীয়া নদী ভরাট করে নির্মিত সড়কটি ঘুরে দেখলে যে কেউ বলবেন, এক কিলোমিটারে ৪৩৭ কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানলে এই সড়ক রক্ষা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ, মাতারবাড়ীর তিন দিকে শক্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এখনো গড়ে তোলা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র হানায়, সাগরঘেঁষা মতারবাড়ীর ১ হাজার ৬০০ একরের লবণ মাঠে নির্মিত হয়েছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি। নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫১ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার ঋণসহায়তা ৪২ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিডেট।
স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দৃষ্টিনন্দন সড়ক ঘুরতে আসেন মাতারবাড়ীর দক্ষিণ রাজঘাট এলাকার বাসিন্দা ও উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসক ইয়াকুব আলী। তিনি বলেন, কয়েক মাস আগে একজন উপদেষ্টার মুখে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মাতারবাড়ীর সোনায় মোড়ানো সড়কের নাম শোনা গিয়েছিল। তারপর থেকে ‘সোনায় মোড়ানো সড়কের’ নাম মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। সড়কে যাঁরা ঘুরতে আসেন, তাঁরা লাভ-ক্ষতির হিসাব মিলেয়ে দেখছেন।
সড়ক প্রকল্পটি মাতারবাড়ীর চেহারা পাল্টে দিয়েছে উল্লেখ করে মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এস এম আবু হায়দার বলেন, দৃষ্টিনন্দন সড়ক হওয়ার পর থেকে মাতারবাড়ীর জায়গা-জমির দাম বাড়ছে। সড়ক ও সেতু হওয়ায় মানুষের ভোগান্তি কমেছে। রাতের বেলায়ও মানুষজন নির্বিঘ্নে মহেশখালী, কক্সবাজার, চকরিয়া, পেকুয়া, চট্টগ্রাম যাতায়াত করার সুযোগ পাচ্ছেন।
কুহেলীয়া নদীর পানি চলাচলের জন্য সড়কের বিভিন্ন স্থানে ৪টি স্লুইসগেট, ১৩টি কালভার্ট ও ৩টি সেতু এবং সড়কের দুই পাশে ২৯৪টি সোলার বাতি স্থাপন করা হয়েছে। জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে সড়কের দুই পাশে বসানো হয় সিসি ব্লক।
সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার কোম্পানি লিমেটেডের প্রকল্প পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের জুন মাসে সড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পে দুর্নীতি হয়নি। সড়ক নির্মাণ করতে মাতারবাড়ী, ধলঘাট, কালারমারছড়া ও বদরখালী ইউনিয়নে ১০১ একর জায়গা অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। এ জন্য ব্যয় বেড়েছে।