খাগড়াছড়ির রামেসু বাজারে সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয় থৈইচিং মারমা। কথা বলতে গিয়ে তাঁর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা টুনি মারমা ও মা দানুপ্রু মারমা কান্নায় ভেঙে পড়েন। গতকাল বেলা ২টায় খাগড়াছড়ি রামেসু বাজারের মারমাপাড়ায়
খাগড়াছড়ির রামেসু বাজারে সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয় থৈইচিং মারমা। কথা বলতে গিয়ে তাঁর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা টুনি মারমা ও মা দানুপ্রু মারমা কান্নায় ভেঙে পড়েন। গতকাল বেলা ২টায় খাগড়াছড়ি রামেসু বাজারের মারমাপাড়ায়

‘আমার ছেলে তো রাজনীতি করে না, মরতে হলো কেন’

জিপচালক থৈইচিং মারমার (২২) সাদাসিধে জীবন। স্ত্রী, ভাই ও মা-বাবাকে নিয়ে সংসার। বিয়ের সাড়ে তিন বছর পর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী টুনি মারমা। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়ও কাছাকাছি। এ নিয়ে পরিবারে আনন্দের বন্যা বইছিল। কিন্তু সেই আনন্দ এখন বিষাদে ছেয়ে গেছে।

গত রোববার খাগড়াছড়ির গুইমারায় সহিংসতার সময় গুলিতে প্রাণ হারানো তিনজনের একজন থৈইচিং। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজারের বটতলপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, তাঁকে হারিয়ে মুষড়ে পড়েছে পুরো পরিবার।

পাহাড়ি এলাকায় সড়কের পাশে আধা পাকা বাড়ি থৈইচিংয়ের। সাজেক রুটে জিপ চালাতেন তিনি। বাড়ির সামনে রাখা আছে সে জিপও। শুধু থৈইচিং নেই।

সোমবার মধ্যরাতে থৈইচিংয়ের দাহ সম্পন্ন হয়। তাঁর বাবা হলাচেই মারমা বলেন, ছেলের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। আগামী ৯ তারিখ ডেট। ছেলের এমন পরিণতিতে সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মন ভেঙে গেছে। তাঁর প্রশ্ন, ‘আমার ছেলে তো রাজনীতি করে না, তবু কেন মরতে হলো?’

হলাচেই মারমা সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ছেলে বলেছিল দুপুরে ভাত খেয়ে বাজারে যাবে। সোয়া ১১টার দিকে ভাতও খেয়েছি দুজন। ও ভাত খেয়ে বের হয়েছে। বাজারের দিকে যাবে বলছিল। কিছুক্ষণ পর শুনি কিছু ছেলে চিৎকার করছে। মনে হয়েছে কোনো মিছিল হবে। ঝামেলা হতে পারে। ঘরে বসে মোবাইলে লাইভ দেখলাম। এরপর বাজার থেকে ফোন আসে, ছেলে গুলি খেয়েছে।’ কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে আসে হলাচেই মারমার।

কোনো মামলা করতে চান না জানিয়ে বাবা হলাচেই মারমা বলেন, ‘আমি চাই না আমার মতো কোনো বাপ-মার বুক খালি হোক। কোনো ঝামেলায় পড়তে চাই না। ছেলে হত্যার বিচার চাই। সরকার করবে। আর ছেলের স্ত্রীর জন্য একটা চাকরি চাই।’

স্বামীর সঙ্গে শেষ মুহূর্তের স্মৃতি মনে করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন টুনি মারমা। বলেন, ‘সকালে বের হয়নি সে। দুপুরে বের হয়েছে। ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে শুনেছি, তার গুলি লেগেছে।’

খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনার প্রতিবাদে শনিবার থেকে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আসছে পাহাড়ি সংগঠন ‘জুম্ম ছাত্র–জনতা’। এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রোববার গুইমারার রামেসু বাজারে বিক্ষোভ ও সহিংসতা ঘটে। পাহাড়িদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় স্থানীয় একটি পক্ষ।

বিক্ষোভ ও সহিংসতা চলাকালে তিন পাহাড়ির মৃত্যু হয়। থৈইচিং মারমা ছাড়া অন্য দুজন হলেন উপজেলার সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নের দেবলছড়ি চেয়ারম্যানপাড়ার আথুই মারমা (২১), হাফছড়ি ইউনিয়নের সাং চেং গুলিপাড়ার আথ্রাউ মারমা (২২)। সেনাবাহিনীর মেজরসহ আহত হন অন্তত ২০ জন। এ সময় আগুনে পুড়ে যায় বাজারের দোকানপাট ও বাড়িঘর। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৪০টি দোকান ও ৫০টির মতো বসতঘর।

তদন্ত কমিটি গঠন

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল খন্দকার বলেছেন, খাগড়াছড়ির ১৪৪ ধারা তুলে নেওয়ার আগে অবরোধ প্রত্যাহার করতে হবে। খাগড়াছড়ির চলমান পরিস্থিতি আলোচনার টেবিলে বসে সমাধান করতে চান। অবরোধ আহ্বানকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। তাঁদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সহিংসতার ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সদস্যদের নাম পরে জানানো হবে।

গতকাল দুপুরে খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজার পরিদর্শনের সময় জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের বলেন, আহত ব্যক্তিদের যাতে সুচিকিৎসা নিশ্চিত হয়, এর জন্য প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের পাশে থাকবে প্রশাসন। পুনর্বাসন করা হবে পরিবারকে। তবে যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়।

জেলা পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বলেন, নিহত ব্যক্তিদের পরিবার মামলায় অনাগ্রহ হলে পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করা হবে। খাগড়াছড়িতে সহিংসতা, সংঘর্ষের ঘটনায়ও মামলা হবে।

এদিকে গুইমারা রিজিয়নের জোন কমান্ডার লে. কর্নেল ইসমাইল শামস আজিজী সাংবাদিকদের বলেছেন, রোববার ইউপিডিএফ ও এর অঙ্গসংগঠনের সদস্যরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সড়ক অবরোধ করে। তাঁদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার অনুরোধ জানালেও তাঁরা শোনেননি।

এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ওই দিন ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গুলতি, লাঠিসোঁটা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে সেনাসদস্যদের ওপর হামলা করে। এতে ৩ জন কর্মকর্তা ও ১০ জন সদস্য আহত হন। সংঘর্ষ চলাকালে আনুমানিক বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রামেসু বাজার ও জঙ্গল থেকে ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ৪-৫ বার অটোমেটিক অস্ত্র দিয়ে গুলি করে।

উপদেষ্টার অভিযোগ, ইউপিডিএফের অস্বীকার

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেছেন, ‘জুম্ম ছাত্র–জনতার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কথা বলেছি। ছয়জন এসেছে তারা। এই ছয়জনই ইউপিডিএফ। কারণ, খাগড়াছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফ ছাড়া কোনো কিছু নেই। আমি একে একে তাদের জিজ্ঞেস করেছি। তারা বলেছে ছয়জনই ইউপিডিএফ।’ সোমবার রাতে রাঙামাটি শহরের পূজামণ্ডপ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

ইউপিডিএফের অন্যতম সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, ‘এ ছয়জন আমাদের সদস্য বা কর্মী নয়। এরা সাধারণ শিক্ষার্থী ও নিরীহ জনগণ।’

জুম্ম ছাত্র–জনতার একজন মুখপাত্র কৃপায়ন ত্রিপুরা বলেন, ইউপিডিএফ ট্যাগ লাগানো হয়েছে, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যমূলক ও অপমানজনক। সুপ্রদীপ চাকমা যদি অবিলম্বে বক্তব্য প্রত্যাহার না করেন, তাহলে জুম্ম ছাত্র-জনতা আর কোনো আলোচনায় অংশ নেবে না।