‘কদমি’ লিচুর স্বাদে মজেছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের নগরী নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ। বাড়ির ছোট্ট উঠান কিংবা বাণিজ্যিক বাগান—সবখানেই গাছে গাছে ঝুলছে রসাল এই ফল। বাজারে কদমি লিচুর ব্যাপক চাহিদা থাকায় বাগানগুলোয় বিরতিহীনভাবে চলছে লিচু সংগ্রহের কাজ। তবে এ বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় সোনারগাঁয়ের লিচুর মান ও ফলন কমেছে, বলছেন বাগানমালিকেরা।
জনশ্রুতি আছে, প্রায় ২০০ বছর আগে কোনো এক সাধক পৌরসভার পানাম গাবতলী এলাকায় দুটি লিচুগাছ রোপণ করেছিলেন। সেই লিচু গুণে-মানে অনন্য। স্বাদে টক-মিষ্টি।
লালচে খাঁজকাটা আবরণের এই লিচুর ভেতরটা অন্যান্য লিচুর তুলনায় ভরাট ও রসাল শাঁস, আকারে বড় আর বিচি ছোট। সেই লিচুর নামডাক ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। পরে সাধকের রোপণ করা দুটি গাছ থেকেই কলম করে ডাল নিয়ে রোপণ করা হয় আশপাশের এলাকায়। সোনারগাঁ ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে কদমি লিচুর নামডাক। আর সাধকের রোপণ করা সেই গাছকে ঘিরে লোকমুখে ওই এলাকার নাম হয়ে গেছে ‘সাধুরবাগ’।
গত সোমবার সাধুরবাগের ওই বাগানে গিয়ে দেখা যায়, গাছে গাছে পাকা লিচু ঝুলছে। শ্রমিকেরা লিচু সংগ্রহ করছেন। তারপর মানভেদে বাছাই করে সেসব লিচু পাঠিয়ে দিচ্ছেন ঢাকার আড়তে। সেখানেই কথা হয় বাগানের ব্যাপারী হেকিম আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, বাগানে প্রায় ২০০ গাছ আছে। এসব গাছ থেকে এ বছর প্রায় তিন লাখ লিচু সংগ্রহ করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
হেকিম আলী আরও বলেন, মৌসুমের শুরুতে অন্তত পাঁচ লাখ লিচু আশা করেছিলেন। কিন্তু অনাবৃষ্টির কারণে হাজার হাজার লিচু ঝরে পড়ছে। পোকার আক্রমণ বাড়ছে। লিচু আকারেও কিছুটা ছোট হয়েছে। পাঁচ বছর ধরে এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে।
মোগরাপাড়া চৌরাস্তা এলাকার লিচু ব্যবসায়ী মো. মুন্না বলেন, প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত মোগরাপাড়া চৌরাস্তা মসজিদের সামনে সোনারগাঁয়ের লিচুর হাট বসে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পাইকারেরা এই হাট থেকে নিলামে লিচু কিনে নিয়ে যান। ২০ বছর ধরে এই হাট থেকে লিচু কিনে তিনি খুচরা বিক্রি করছেন। এ বছর প্রতি ১০০ কদমি লিচু ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কদমি লিচুর পাশাপাশি ‘পাতি’ লিচু ও ‘চায়না-৩’ জাতের লিচু বেশি চাষ হয় সোনারগাঁয়ে। এই উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ৮৫টি গ্রাম লিচুর জন্য প্রসিদ্ধ। তবে সোনারগাঁ পৌরসভার গোয়ালদী, হরিষপুর, দুলালপুর, পানাম গাবতলী, খাসনগর দীঘিরপাড়, চিলারবাগ, ইছাপাড়া, দত্তপাড়া, হাতকোপা, অজুন্দী, বাগমুছা, গোবিন্দপুর, লাহাপাড়া, বালুয়াদীঘিরপাড় ও বৈদ্যেরবাজার ইউনিয়নের হাড়িয়া, হামছাদী, দামোদরদী, পঞ্চবটী, মোগরাপাড়া ইউনিয়নের ফুলবাড়িয়া ও গোহাট্টা এলাকায় সবচেয়ে বেশি লিচুবাগান আছে। এসব এলাকার প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় ও আশপাশের ভিটাবাড়িতে লিচুর চাষ করা হয়।
সোনারগাঁ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আফরোজা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অন্তত ১৫ দিন আগে সোনারগাঁয়ের লিচু বাজারে আসে। বর্তমানে ঢাকার প্রায় ৮০ শতাংশ লিচুই সোনারগাঁয়ের। উপজেলায় এ বছর ১০৫ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৫ হেক্টর বেশি।
বাগান বাড়লেও এ বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় ফলন কমেছে বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা। তিনি বলেন, গত বছর সোনারগাঁয়ে ৭০০ মেট্রিক টন লিচু উৎপাদিত হয়েছে। এ বছর ৬৮০ থেকে ৭০০ মেট্রিক টন উৎপাদিত হবে। এরই মধ্যে সোনারগাঁয়ের ৮০ শতাংশ লিচু বাজারে চলে এসেছে।