
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে আলোচিত নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার দরবারে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও কবর থেকে মরদেহ তুলে নিয়ে পোড়ানোর ঘটনায় নিরপরাধ কাউকে হয়রানি কিংবা গণগ্রেপ্তার করা হবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. সিদ্দিকুর রহমান। আজ সোমবার দুপুরে নুরাল পাগলার বাড়ি ও দরবার এলাকা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
বেলা একটার দিকে গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড জুড়ান মোল্লার পাড়ায় নুরাল পাগলার বাড়ি ও দরবার পরিদর্শন করেন ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি সিদ্দিকুর রহমান। পরে সাংবাদিকদের তিনি জানান, যিনি প্রকৃত অপরাধী, তাঁকেই গ্রেপ্তার করা হবে। যাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য–প্রমাণ বেরিয়ে আসবে, যাঁর অপরাধ খুঁজে পাওয়া যাবে, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে কেউ যদি প্রশাসনের লোক থাকে বা প্রশাসনের বাইরেও থাকে—কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
এ সময় রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার মো. কামরুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আবু রাসেল, গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে জানিয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন, ‘আশা করি, জনগণকে সুবিচার দিতে পারব। গণগ্রেপ্তার বলতে যা বোঝায়, ব্যাপারটা কিন্তু সেটা না, আইনকানুন সাক্ষ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা জাস্টিস করব। এ ধরনের ঘটনায় জনগণ ভাবতে পারে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হবে, ব্যাপারটা আসলে সেটা না—যারাই অপরাধী, তারাই আইনের আওতায় আসবে।’
অতিরিক্ত ডিআইজি আরও বলেন, ‘একটি সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হতে পারে, সমাবেশে অশান্তি হতে পারে, কিন্তু সবাই জড়িত থাকে না। যারা আইনশৃঙ্খলা ভেঙেছে, তাদের আইনের আওতায় আনব। একটা সমাবেশে হাজার হাজার লোক থাকতে পারে, নাশকতা কিন্তু সবাই করে না। সবাইকে গ্রেপ্তার করা, সবাইকে আইনের আওতায় আনা—এটা আইনসম্মত না।’
গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত দফায় দফায় নুরাল পাগলার দরবার ও বাড়িতে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা শরিয়ত পরিপন্থীভাবে দাফনের অভিযোগ তুলে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় নুরাল পাগলার দরবার ও বাড়ি। উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে একদল লোকের এই হামলায় ১০ থেকে ১২ জন পুলিশ সদসসহ অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন। পুলিশের দুটি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। হামলায় আহত হয়ে মারা যান রাসেল নামের এক ব্যক্তি।
আরও ৯ জন গ্রেপ্তার
নুরাল পাগলার দরবারে হামলার আগে পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় আরও ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয় রোববার রাতে। আর তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয় আজ দুপুরে। রাতে গ্রেপ্তার ছয়জনকে আজ দুপুরে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
রাতে গ্রেপ্তার ছয়জন হলেন ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ডিগ্রিরচর বারখাদা গ্রামের নিজাম উদ্দিন সরদারের ছেলে মোহাম্মদ ফেরদৌস সরদার, গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের নতুনপাড়া ময়ছের মাতুব্বর পাড়ার শওকত সরদারের ছেলে জীবন সরদার, গোয়ালন্দ পৌরসভার শাকের ফকির পাড়ার হেলাল শেখের ছেলে সাইফুল ইসলাম (শুভ), শহরের জুড়ান মোল্লার পাড়ার আবদুল মালেকের ছেলে সাগর হোসেন, উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের দিরাজতুল্লা মৃধা পাড়ার মোকলেছুর রহমান মৃধার ছেলে হায়াত আলী মৃধা ও আদর্শ গ্রামের আবদুস সালাম খাঁর ছেলে মোহাম্মদ বিপ্লব ওরফে বিল্লু। বিল্পব স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পরে ছয়জনের সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
আজ দুপুরে গ্রেপ্তার তিনজন হলেন গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ১নং ব্যাপারীপাড়ার আইয়ুব আলী গাজীর ছেলে মো. আলমগীর গাজী (৪৫), গোয়ালন্দ পৌরসভার নসর উদ্দিন সরদারপাড়ার ইসাক সরদারের ছেলে সোহান সরদার (৩৩) ও পৌরসভার দেওয়ান পাড়ার নেকবার আলী শেখের ছেলে রিয়াজ হোসেন ওরফে রিতান্ত (২১)। এই তিনজনকে উপজেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁদের আদালতে তোলার প্রস্তুতি চলছে।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. শরীফ আল রাজীব জানিয়েছেন, গতকাল রোববার রাতে গ্রেপ্তার ছয়জনকে আজ সোমবার দুপুরে আদালতে পাঠানো হয়। এই ছয়জনের মধ্যে মোহাম্মদ বিপ্লব ওরফে বিল্লু ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এ নিয়ে মোট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো। গত শনিবার দিবাগত রাতে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে কাজী অপু নামের একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বাকি তিনজনকেও আদালতে তোলা হবে।
পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় মামলাটি করেছেন গোয়ালন্দ ঘাট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সেলিম মোল্লা। মামলায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছে। তবে নুরাল পাগলার বাড়ি ও দরবারে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পরিবার থেকে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।
নুরাল পাগলার দরবার ও বাড়িতে ফরিদপুরের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ক্রাইম সিন বিভাগের একটি দল সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আলামত সংগ্রহ করেন।