গ্রাহকদের কাছে খবরের কাগজ পৌঁছে দিতে বাইসাইকেলে নিয়মিত অলি-গলি ছুটে চলেন স্বপন কণ্ডু (৫৭)। গতকাল মঙ্গলবার নড়াইল শহরের রূপগঞ্জ বাজার এলাকায়
গ্রাহকদের কাছে খবরের কাগজ পৌঁছে দিতে বাইসাইকেলে নিয়মিত অলি-গলি ছুটে চলেন স্বপন কণ্ডু (৫৭)। গতকাল মঙ্গলবার নড়াইল শহরের রূপগঞ্জ বাজার এলাকায়

প্রতিদিন গ্রাম থেকে সাইকেলে শহরে গিয়ে পত্রিকা বিলি করেন নড়াইলের স্বপন

চিত্রা নদীর পাড়ে হেমন্তের অপ্রশস্ত কুয়াশা তখনো পুরোপুরিভাবে কাটেনি। এমন সময় অদূরের গ্রাম থেকে নড়াইল শহরে গিয়ে হাজির হন স্বপন কণ্ডু (৫৭)। শহরের হাতিরবাগান বাসস্ট্যান্ডে দিনের পত্রিকাগুলোর অপেক্ষায় থাকেন। যশোর থেকে আসা পত্রিকার বান্ডিল বুঝে পাওয়া মাত্রই চেনা ছন্দে কাজ গুছিয়ে নেন। রিল খুলে পত্রিকাগুলো সাজিয়ে নেন নিজের বাইসাইকেলে রাখা সামনের ব্যাগ ও পেছনের ক্যারিয়ারে। এরপর বাইরে বেরিয়ে শুরু হয় স্বপনের হাঁকডাক, ‘এই খবর আছে, খবর আছে, আজকের তাজা খবর...।’

আগ্রহী পথচারীরা এগিয়ে যান স্বপনের কাছে, কেউ কিনে নেন এক কপি, কেউ দুটি। ব্যস্ততার সেই মুহূর্ত পেরোলেই স্বপনের সাইকেল ছুটে চলে শহরের রাস্তা-গলিপথ ধরে—দোকানপাট, বাসাবাড়ি ও অফিসে—সব জায়গায় খবর পৌঁছে খবর পৌঁছে দেন।

গতকাল মঙ্গলবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত স্বপনের সঙ্গে ঘোরেন এই প্রতিবেদক। এ সময় জানা যায়, স্বপনের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার হাটবাড়িয়া গ্রামে। সেখান থেকে প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে শহরে গিয়ে তিন দশক ধরে করছেন পত্রিকা বিক্রির কাজ। সংসারে আছে স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে ও বৃদ্ধ শাশুড়ি। বড় ছেলে স্নাতকোত্তরে পড়ছেন এবং মেয়ে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। সংসারের সব খরচই চলে স্বপনের পত্রিকা বিক্রির টাকায়।

স্বপন কণ্ডু স্মৃতি হাতড়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুবক বয়সে শূন্য হাতে বিয়ে করিছিলাম। আর্থিক সংকটে তখন খুবই অসহায় অবস্থা। এরই মধ্যি বাড়ির পাশের সাংবাদিক অশোক দাদা আর যশোর থেকে প্রকাশিত লোকসমাজ পত্রিকার তখনকার ম্যানেজার বাদল ভাই আমাকে পত্রিকা বিক্রির প্রস্তাব দেন। বাদল ভাইয়ের কথামতোই পত্রিকা বিক্রি শুরু করিছিলাম। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখন এই কাজই করে যাচ্ছি। এই আয়েই আমি বাড়িতে ঘর দিছি। দুই ছেলেমেয়েরে পড়াশোনা করাচ্ছি।’

দুই পাঠককে পত্রিকা বুঝিয়ে দিচ্ছেন স্বপন কণ্ডু (৫৭)। গতকাল মঙ্গলবার সকালে নড়াইল শহরের বউবাজার এলাকায়

তবে দিন দিন পত্রিকার চাহিদা কমছে বলে মনে করেন স্বপন কণ্ডু। এ প্রসঙ্গে তাঁর ভাষ্য, ‘এখন নেটের (অনলাইন) যুগ আসাতে পত্রিকার চাহিদা কমে যাচ্ছে। এখনকার পোলাপান কাগজ পড়তে চায় না। যাদের পত্রিকা পড়ার অভ্যাস, তারাই পত্রিকা নেয়। আর কিছু সংবাদ-বিজ্ঞাপনের জন্য এই পেশা এখনো টিকে আছে। স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকা মিলে আড়াই শ কপি পত্রিকা চালাতে পারি।’

আক্ষেপের সুরে স্বপন বলে গেলেন, ‘একসময় পত্রিকা বিক্রি করে ১৪-১৫ হাজার টাকার মতো আয় করতাম। জিনিসের দাম কম ছিল, তখন সেই টাকা দিয়ে মেলা কিছু করা যাইত। সংসার চালিয়েও কিছু সঞ্চয় হতো। কিন্তু চাহিদা কমার কারণে পত্রিকা অফিস থেকে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়। এরপরও এখন ১০-১২ হাজার টাকার বেশি আয় হয় না। এ আয়ে সংসার চালানো বড় কঠিন। এ কারণে নতুন কেউ এই পেশায় আসে না। পেশাটির প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মে গেছে, তাই ছাড়তে পারি না।’

রোদ-বৃষ্টি, ঝড়ঝাপটা যা–ই আসুক না কেন, স্বপনের পত্রিকা বিক্রি কোনো দিন বন্ধ থাকে না। নিজের চরম দুর্দিনেও তিনি পত্রিকা বিলি বন্ধ রাখেননি। স্বপন বলেন, ‘একদিন পত্রিকা বিক্রি করতে শহরে গিয়ে খবর পাই, আমার মা মারা গেছেন। মা মারা যাওয়ার খবর পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে গ্রাহকদের কাছে পত্রিকা বিলি করেছি। এভাবে গ্রাহকদের ধরে রেখেছি।’

কাজের প্রতি স্বজনের নিষ্ঠা ও একাগ্রতা দেখে খুশি তাঁর গ্রাহকেরাও। তাঁদের কাছে স্বপন যেন নির্ভরতার আরেক নাম। রেজাউল ইসলাম নামের এক গ্রাহক বলেন, ‘স্বপন বাবু একজন ভালো সংবাদপত্র বাহক। দীর্ঘদিন ধরে তিনি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকাটি নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের হাতে পৌঁছে দেন।’