অনুশীলনে ব্যস্ত ফুটবলাররা। সম্প্রতি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে
অনুশীলনে ব্যস্ত ফুটবলাররা। সম্প্রতি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে

নিজের স্বপ্ন পূরণ হয়নি, অন্যদের জন্য গড়েছেন ‘স্বপ্নভূমি ফুটবল একাডেমি’

ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখেছিলেন বড় হয়ে ভালো ফুটবলার হবেন। তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে তিনি দমে যাননি। ফুটবলার না হতে পারলেও তিনি এখন গড়ে তুলেছেন খেলোয়াড় তৈরির একাডেমি। গ্রামের মাঠে দেওয়া হচ্ছে তাদের প্রশিক্ষণ। সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গড়ে তুলছেন ভালো মানের ফুটবল খেলোয়াড়। এরই মধ্যে কেউ কেউ বিকেএসপিতে সুযোগও পেয়েছেন। বর্তমানে ফুটবলার তৈরির এই প্রতিষ্ঠানে শতাধিক কিশোর-তরুণ প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।

ফুটবলার তৈরির তরুণ এই উদ্যোক্তার নাম মিলন হাসান। নিজে খেলোয়াড় না হওয়ার আক্ষেপ থেকে ফুটবল খেলোয়াড় তৈরির এই কারখানার নাম দিয়েছেন ‘স্বপ্নভূমি ফুটবল একাডেমি’। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে এর অবস্থান। ব্যবসার সুবাদে মিলন হাসান ঢাকায় থাকেন। তবে প্রতিদিন এলাকায় একাডেমির কোচসহ খেলোয়াড়দের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। নেন খোঁজখবর।

মিলন হাসানের এমন উদ্যোগে আশপাশের গ্রাম থেকেও ছুটে আসছেন কিশোর–তরুণেরা। সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে অনুশীলন করার সুযোগসহ আছে অনেক সুযোগ-সুবিধা। স্থানীয় লোকজন বলছিলেন, কয়া গ্রাম যেন সেই ২০ বছর আগে চলে গেছে। মিলন হাসানের জাদুতেই এসব কিছু সম্ভব হয়েছে। এখন এলাকায় বখাটের উৎপাত নেই। কিশোর–তরুণেরা পড়াশোনা আর খেলাধুলাতেই মজে থাকে সব সময়। মিলন হাসান ব্যবসায়িক কাজে অধিকাংশ সময়ই রাজধানী ঢাকায় থাকেন। কিন্তু রাজধানীতে থাকলেও নিজ গ্রামের জন্য সব সময়ই মন কাঁদে।

মিলন হাসান

মিলন হাসান বলেন, কয়েক বছর আগেও গ্রামে উঠতি বয়সী ছেলেরা মুঠোফোনে আসক্ত ছিল। এলাকায় ছিল কিশোর অপরাধ চক্রের দৌরাত্ম্য। প্রায়ই মারামারি-হাতাহাতি হতো। তাই দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে কথা বলে গড়ে তোলা হয়েছে ওই একাডেমি। এখানে এলাকার ছেলেরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ নেয়। স্বপ্নœভূমি ফুটবল একাডেমি এলাকায় আলো ছড়িয়ে চলছে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এলাকায় তেমন মারামারি হয় না। ছেলেরা বিকেল হলেই কয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে চলে আসে।

কথা প্রসঙ্গে মিলন হাসান জানালেন, বাড়িতে যখন যাওয়া হয় তখন কিশোর তরুণদের খোঁজ নেন। একসময় মাঠে তেমন কাউকে পাওয়া যেত না। বড়জোর ১০–১২ জন আসত। ২০২২ সালের দিকে তাদের নিয়েই একাডেমি গড়ে তোলা হয়। এ জন্য স্থানীয় বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম ও আলমগীর হাসান নামের দুজনকে কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁরা এলাকার কিশোর–তরুণদের খুঁজে বের করতে থাকেন। কয়া গ্রাম থেকে নন্দনালপুর, শিলাইদহসহ আশপাশের কয়েক গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে একাডেমির খবর। এসব গ্রাম থেকে আসতে থাকে ছেলেরা। বর্তমানে একাডেমিতে ১৫০–এর বেশি খেলোয়াড় আছে।

মিলন গড়ে তুলছেন ভালো মানের ফুটবল খেলোয়াড়। এরই মধ্যে কেউ কেউ বিকেএসপিতে সুযোগও পেয়েছেন।

কোচ তরিকুল ইসলাম জানালেন, প্রতিদিন বেলা তিনটার পর ছেলেরা কয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে চলে আসে। তাদের বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বুট, জার্সি, ফুটবলসহ যাবতীয় সরঞ্জামাদি দেওয়া হয়। এমনকি কারও কারও পড়াশোনার জন্য বইখাতা বা স্কুল–কলেজের বেতনের টাকাও দেওয়া হয়। তাদের পরিবারের অভিভাবক মারা গেলে আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হয়। এ ছাড়া খেলোয়াড়দের মধ্যে অনেকে স্কুল–কলেজে পড়ে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পর তারা পড়াশোনায় মনোযোগী হয় কি না, সে ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়ার জন্য নজরুল ইসলাম নামের একজনকে রাখা হয়েছে। খেলোয়াড়দের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি খোঁজ নেন। তারা ঠিকমতো পড়াশোনা করছে কি না।

কোচ তরিকুল ইসলাম আরও বলেন, ইতিমধ্যে কয়েকজন খেলোয়াড় ঢাকাতে বি লিগে খেলার জন্য মনোনীত হয়েছে। অন্তত ছয়জনকে ঢাকায় পাঠানো হবে। কুষ্টিয়া জেলা ছাড়াও খুলনা বিভাগীয় টুর্নামেন্টেও খেলেছে কেউ কেউ। আশা করা যাচ্ছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভালো খেলোয়াড় দেশের অনূর্ধ্ব কোনো এক জাতীয় দলে খেলবে। বিকেএসপিতেও একজন খেলোয়াড়ের ভর্তির সুযোগ প্রক্রিয়াধীন।

খেলোয়াড় সাব্বির রহমান পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করেন। পাশাপাশি এই একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেন। তিনি বলেন, এখানে খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মিলন হাসান ভাই নিয়মিত খোঁজখবর নেন।

বিকেল হলেই কয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে শুরু হয় প্রশিক্ষণ

রাজিন আহমেদ নামের দশম শ্রেণির এক ছাত্র বলে, ‘স্কুল ছুটির পর মাঠে চলে যাই। প্রশিক্ষণে ফুটবলের অনেক কিছু শিখতে পারি। এ ছাড়া এই একাডেমি থেকে আরও অনেক কিছু সহায়তা করা হয়ে থাকে।

ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কথা হয় মিলন হাসানের সঙ্গে। আবেগতাড়িত হয়ে তিনি বললেন, ‘এলাকায় গেলে সাধ্যমতো অসহায় মানুষের সহায়তা করেন। গ্রামের ছেলেরা খেলার সরঞ্জামাদি পায় না। তাদের স্পৃহা আর ফুটবলের প্রতি ভালোবাসার টান স্পষ্ট বুঝতে পারি। কেননা, আমারও ফুটবলের প্রতি ছিল গভীর প্রেম। মাত্র ১৮ মাস বয়সে মাকে হারাই। মা–বাবার ১০ সন্তান। পড়াশোনা ছিল অনেক সংগ্রামের। পড়াশোনা শেষ করে হয়ে গেলাম ব্যবসায়ী। তাই এলাকায় গড়ে তুললাম ফুটবল একাডেমি। সেই চিন্তা থেকেই একাডেমিতে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা, কোচিং স্টাফ, পর্যাপ্ত ফুটবল, জার্সিসহ নানা উপকরণ রেখেছি। যেন এখান থেকে আগামী দিনে ফুটবলারদের কোনো অভাববোধ বা আক্ষেপ না থাকে। না পাওয়ার আক্ষেপও যেন না থাকে।’

মিলন হাসান দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘আশা করি, আমার একাডেমি থেকে চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে জাতীয় ফুটবল দলে খেলবে। আমাদের কুমারখালী থেকে অতীতেও অনেক ফুটবলার জাতীয় পর্যায়ে খেলেছেন। মাঝে খানিকটা ভাটা পড়লেও আবারও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরবে বলে আশা করি।’

মিলন হাসান ভবিষ্যতে একটি স্পোর্টস একাডেমি করতে চান। করতে চান দেশের নামকরা ক্লাবও। যেখানে প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ পাবেন তৃণমূলের মেধাবী খেলোয়াড়েরা।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে মিলন হাসানের এমন উদ্যোগ এখন অনেকেরই আশার আলো। মিলন হাসানের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি কয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ঢাকার বশির উদ্দিন আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি, বিসিআইসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর রসায়নে সম্পন্ন করেন নিজ ভূমি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে। পড়াশোনা শেষ করে শূন্য পকেটেই আবার পাড়ি জমান ঢাকাতে। তারপর অনেক সংগ্রাম ও কঠোর পরিশ্রম করে তাঁদের জীবন কাটাতে হয়। একটি চাকরি পেলেও সেটিও হাতছাড়া হয়ে যায়। এরপর শুরু করেন ব্যবসা।

অনেক বাধাবিপত্তি কাটিয়ে আজ তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। গড়ে তুলেছেন ভূমি প্রপার্টিজ লিমিটেডের আবাসন প্রকল্প স্বপ্নভূমি। এলাকায় এলে সাধ্যমতো সহায়তা দিয়ে মানুষের সেবা করেন।

মিলন হাসান বলেন, এলাকার তরুণদের ক্রীড়াক্ষেত্রে দক্ষ করতে ভবিষ্যতে একটি স্পোর্টস একাডেমি করতে চান। করতে চান দেশের নামকরা ক্লাবও। যেখানে প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ পাবেন তৃণমূলের মেধাবী খেলোয়াড়েরা।