খুলনার দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক সহ সভাপতি মাহবুবুর রহমান মোল্লা
খুলনার দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক সহ সভাপতি মাহবুবুর রহমান মোল্লা

খুলনায় যুবদল নেতা হত্যায় ভিডিও ফুটেজে শনাক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে গুরুত্ব দিচ্ছে পুলিশ

খুলনার দৌলতপুরে সাবেক যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লা হত্যার রহস্য এখনো পুরোপুরি উদ্‌ঘাটিত হয়নি। তবে ঘটনার ধরন ও ভিডিও বিশ্লেষণ থেকে পুলিশ মনে করছে, এতে চরমপন্থী এক নেতার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহযোগী জড়িত থাকতে পারেন।

গত শুক্রবার হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে সংগ্রহ করা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে কয়েকজনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। এসব ফুটেজ থেকে নেওয়া স্থিরচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় কয়েকজন জানান, ওই ছবিতে চরমপন্থী নেতা হুমায়ুন কবির ওরফে হুমার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা আছেন। পুলিশও বিষয়টি স্বীকার করেছে।

এ সম্পর্কে পুলিশের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরো রহস্য এখনো উদ্‌ঘাটন হয়নি। সুস্পষ্ট কারণ নির্ধারণ করা যায়নি। তবে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, হুমার (হুমায়ুন কবির) সহযোগীরা একটি মোটরসাইকেলে যাচ্ছে। তারাই হত্যা করতে পারে—এদিকটাই আপাতত জোরালোভাবে সামনে এসেছে। ওই তিনজনের একজনকে গ্রেপ্তার করতে পারলে আরও নিশ্চিত হওয়া যাবে। পাশাপাশি অন্যান্য দিকও আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি।’

নিহত মাহবুবুর রহমানের বাড়ি খুলনা নগরের দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ায়। তিনি দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি ছিলেন। গত শুক্রবার দুপুরে তিনি বাসার সামনে নিজের প্রাইভেট কার পরিষ্কার করছিলেন। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে তিনজন দুর্বৃত্ত এসে তাঁকে গুলি করে এবং দুই পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। দুর্বৃত্তদের একজনের মাথায় হেলমেট ছিল। ওই ঘটনার পর নিহত মাহবুবুরের বাবা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। পুলিশ এখন পর্যন্ত দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

ছড়িয়ে পড়া স্থিরচিত্র দেখে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, মোটরসাইকেলের মাঝখানে বসা যুবক আসিফ মোল্লা ও চালক কাজী রায়হান ইসলাম। দুটি ছবিতে পেছনে থাকা যুবকের চেহারা আলাদা। ধারণা করা হচ্ছে, হত্যার সময় আশপাশে আরও কয়েকজন ‘ব্যাকআপ’ হিসেবে অবস্থান করছিলেন।

পুলিশ, স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এলাকায় বেপরোয়া আচরণ, দখল, জমি বিক্রির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণসহ নানা বিষয়ে নিহত মাহবুবুর রহমানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে এক চরমপন্থী নেতার আত্মীয় হওয়ায় এলাকায় তাঁর প্রভাব ছিল। আধিপত্য নিয়ে স্থানীয় উঠতি সন্ত্রাসী ও চরমপন্থীদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়ে। মাদক নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির বিরোধেও একাধিক পক্ষের টার্গেটে পরিণত হন তিনি।

দৌলতপুর, দেয়ানা ও তেলিগাতি এলাকায় চরমপন্থী দলগুলোর আধিপত্য নিয়ে একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গত ১৫ মার্চ চরমপন্থী নেতা শেখ শাহীনুল হককে (বড় শাহীন) গুলি করে হত্যা করা হয়। একসময় তাঁর দলে ছিলেন মহেশ্বরপাশার হুমায়ুন কবির (হুমা), ক্রসরোডের কাজী রায়হান, ঘোষপাড়ার আসিফ মোল্লা, বুচিতলার ইমন হাওলাদার, হোসেন ঢালী ও আরমান। বর্তমানে দলটি দুটি ভাগে বিভক্ত। হুমায়ুনের নেতৃত্বে আছেন রায়হান, আসিফ ও ইমন; অন্য পক্ষে আছেন হোসেন ঢালী ও আরমান। গত বছরের জুনে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কুয়েটসংলগ্ন খানাবাড়ী এলাকার যুবলীগ নেতা আরিফ হত্যাকাণ্ডেও দুই পক্ষের কয়েকজনের নাম উঠে আসে।

বেশ কয়েক মাস আগে বাগেরহাটের একটি অস্ত্র মামলায় হুমায়ুন, রায়হান, আসিফ ও ইমন গ্রেপ্তার হন। আসিফ, রায়হান ও ইমন গত মাসে জামিনে মুক্তি পান; তবে হুমায়ুন এখনো কারাগারে আছেন। অপর একটি মামলায় হোসেন ঢালী ও আরমানও কারাগারে রয়েছেন।

সূত্রগুলো জানায়, আরমান মাহবুবুরের আত্মীয়। হোসেন ঢালী ও আরমানের মামলার দেখভাল করতেন মাহবুবুর রহমান। এ নিয়ে হুমায়ুন পক্ষের সঙ্গে তাঁর বিরোধ তৈরি হয়। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে হুমায়ুনের সহযোগী মাহবুব এবং তাঁর বন্ধু, দিবানৈশ কলেজের সাবেক ছাত্রদল নেতা জাকিরের বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেন।

নিহত মাহবুবুরের ঘনিষ্ঠ এক রাজনৈতিক সহকর্মী প্রথম আলোকে বলেন, ‘হুমা (হুমায়ুন) গ্রুপ মনে করত, মাহবুবুর তাঁদের ধরিয়ে দিয়েছেন। মাহবুবুর কারাগারে হুমার সঙ্গে দেখা করেও বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, এটা ভুল–বোঝাবুঝি। কিন্তু তারপরও কারাগার থেকেই তাঁর হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।’

দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর আতাহার আলী বলেন, ‘হত্যার নেপথ্যের কারণ মাথায় রেখে তদন্ত চলছে। আমরা সজল নামের একজনকে আগেই গ্রেপ্তার করেছিলাম। রিমান্ডে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাঁর দেওয়া তথ্য যাচাই–বাছাই চলছে। ঘটনার দিন সজলের সঙ্গে থাকা আলাউদ্দীন নামের আরেকজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শিগগিরই হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটন সম্ভব হবে।’