
দেখতে অনেকটা পাকা গাবের মতো। সুমিষ্ট, রসালো। মুখে নিলেই স্বাদে মন ভরে যায়। এই ফলের নাম পার্সিমন। ফল ব্যবসায়ীদের ভাষায়, এটি ‘ধনীদের ফল’। কারণ, একসময় এটি সাধারণ বাজারে বিক্রি হতো কম।
চট্টগ্রাম নগরের স্টেশন রোডে পাইকারি ফলের বড় আড়ত ফলমন্ডিতে ঘুরে দেখা গেল, পাঁচ-ছয়টি আড়তে পার্সিমন বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানালেন, গত বছর এই ফলের পাইকারি দাম ছিল প্রতি কেজি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। এ বছর সেই দাম নেমে এসেছে পাইকারিতে ৭২০ থেকে ৭৮০ টাকায়। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে কেজিতে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কমেছে। দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বিক্রি। খুচরা বাজারে এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকায়, যা গত বছর ছিল ১ হাজার ৪০০ টাকার মতো।
দরদাম আর বিক্রিবাট্টার আগে পার্সিমনের পেছনের গল্পটা জানা জরুরি। বিশ্বের খ্যাতনামা বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থায় এই ফল নিয়ে একাধিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। দেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রকাশনা কৃষি বাতায়নেও রয়েছে নানা তথ্য। গবেষণা অনুযায়ী, পার্সিমন জাপানের জাতীয় ফল। সেখানে এটি ‘কাকি’ নামে পরিচিত। পূর্ব এশিয়া বিশেষ করে চীন, কোরিয়া ও জাপানে প্রায় এক হাজার বছর ধরে এই ফলের চাষ হয়। জাপানে শরৎ ঋতু মানেই গাছভর্তি কমলা রঙের পার্সিমন, যা কবিতা, চিত্রকলা ও গ্রামীণ উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ।
ইতিহাস বলে, দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যসংকটের সময় শুকনা পার্সিমন (হোশিগাকি) বহু মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। সেই স্মৃতি আজও লোককথা আর পারিবারিক গল্পে বেঁচে আছে। এই দীর্ঘ ঐতিহ্যের কারণেই পার্সিমন জাপানে অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয় ফল’-এর মর্যাদা পেয়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে।
পুষ্টিগুণের দিক থেকেও পার্সিমন গবেষকদের আগ্রহের কেন্দ্রে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নাল নিউট্রিয়েন্টস-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এই ফলে রয়েছে প্রচুর ডায়েটারি ফাইবার, ভিটামিন এ ও সি, ক্যারোটিনয়েড, পলিফেনলস ও ট্যানিন। এসব উপাদান শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং হৃদ্স্বাস্থ্য রক্ষা, প্রদাহ কমানো ও রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে।
ব্যবসায়ীরা জানালেন, গত বছর এই ফলের পাইকারি দাম ছিল প্রতি কেজি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। এ বছর সেই দাম নেমে এসেছে পাইকারিতে ৭২০ থেকে ৭৮০ টাকায়। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে কেজিতে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কমেছে।
গতকাল ফলমন্ডির মেসার্স হাটহাজারী ফার্মে দেখা গেল, থরে থরে সাজানো পার্সিমন। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মোহাম্মদ রাশেদ জানালেন, গত বছর জাপান ও থাইল্যান্ড থেকে পার্সিমন এলেও এ বছর বাজারে বেশি দেখা যাচ্ছে ভারতীয় ফল। ভারতের হিমাচল প্রদেশ, কাশ্মীর ও উত্তরাখন্ডে এই ফলের চাষ হয়। ভারতীয় পার্সিমনের দাম তুলনামূলক কম। হাটহাজারী ফার্মে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ কেজি পার্সিমন বিক্রি হচ্ছে। পাইকারিতে কেজিপ্রতি দাম ৬৮০ থেকে ৭৮০ টাকা।
ফলমন্ডির আরেক আড়ত মেসার্স নিউ অহি এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার মুহাম্মদ আবদুল করিম বলেন, গত বছর দাম বেশি থাকায় বিক্রি কম ছিল। এ বছর দাম কমায় বিক্রি বেড়েছে। চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ী, খুলশী ও নাসিরাবাদের মতো বনেদি এলাকায় এ ফলের চাহিদা বেশি। তবে দাম কমে যাওয়ায় এখন হাটহাজারী, পটিয়া ও বোয়ালখালীর দিকেও পার্সিমন যাচ্ছে।
খুচরা বিক্রেতা আজগর ইসলাম মাসখানেক ধরে পার্সিমন বিক্রি করছেন। তিনি জানান, দাম বেশি হওয়ায় সবাই এই ফল কম কেনেন। তিনি প্রতি কেজি ৮০০ টাকায় বিক্রি করেন।
চট্টগ্রামে প্রতিদিন ঠিক কত পার্সিমন বিক্রি হয়, তার নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. তৌহিদুল আলমের হিসাবে, নগরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ হাজার কেজি পার্সিমন বিক্রি হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরে এই ফল বাজারে আসছে। বর্তমানে ১০-১২ জন পাইকারি এবং ৫০ জনের কম খুচরা বিক্রেতা পার্সিমন বিক্রি করছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, পার্সিমনের মৌসুম সাধারণত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। অর্থাৎ এ মাস পরে আর পার্সিমন বাজারে পাওয়া যাবে না। তাই প্রতিবছর আমদানি হয় জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বে পার্সিমন উৎপাদন হয়েছে মোট ৫৫ লাখ টন। এর মধ্যে চীন এককভাবে উৎপাদন করেছে প্রায় ৪০ দশমিক ৬ লাখ টন, যা বিশ্ব উৎপাদনের প্রায় ৮০ শতাংশ। এরপর রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া (প্রায় ২ দশমিক ৪ লাখ টন) ও আজারবাইজান (প্রায় ১ দশমিক ৯ লাখ টন)। ২০২৪ সালের উৎপাদনের তথ্য এখনো প্রকাশিত হয়নি। তবে বিভিন্ন বেসরকারি বাজার বিশ্লেষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে, ২০২৪ সালে পার্সিমনের বৈশ্বিক উৎপাদন ৫৯ লাখ টনের মতো (১ টন সমান ১ হাজার কেজি)।
বাংলাদেশে পার্সিমন পুরোপুরি আমদানিনির্ভর ফল। যদিও দেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় আপেল, কমলা, মাল্টা ও আঙুরের মতো জনপ্রিয় ফল, তবু সাম্প্রতিক সময়ে পার্সিমন ধীরে ধীরে আমদানিকারকদের আগ্রহের কেন্দ্রে এসেছে।
দেশের আবহাওয়া ও মাটি পার্সিমনের কয়েকটি জাতের চাষের জন্য উপযোগী। এটি গাব–জাতীয় ফলের একটি সংস্করণ। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফলটি স্বল্প পরিসরে উৎপাদনের চেষ্টা হচ্ছে। তবে মূল সমস্যা হলো উন্নত মানের চারা পাওয়া যাচ্ছে না।মো. মসিউর রহমান, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
কাস্টমসের তথ্যে চোখ রাখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তথ্য অনুযায়ী, ২০২০–২১ অর্থবছরে পার্সিমন আমদানি হয় ২২ হাজার ৬১০ কেজি। পরের দুই বছরে এই পরিমাণ বেড়ে ৩৬ হাজার ও ৩৫ হাজার ৪৩০ কেজিতে পৌঁছালেও ২০২৩–২৪ অর্থবছরে তা নেমে আসে মাত্র ১৮ হাজার কেজিতে। ব্যবসায়ীরা জানান, ওই বছর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি থাকা এবং বিক্রি ধীরগতির হওয়ায় অনেক আমদানিকারক সতর্ক অবস্থান নেন। তবে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে ২০২৪–২৫ অর্থবছরে। সে বছর আমদানি বেড়ে দাঁড়ায় ৬৪ হাজার ৬৩০ কেজিতে, যা আগের বছরের প্রায় সাড়ে তিন গুণ।
কাস্টমসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি ছিল ৬০ হাজার ৩১০ কেজি। ২০২৫–২৬ অর্থবছরের একই সময়ে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৬৩৬ কেজিতে। অর্থাৎ এক মৌসুমের ব্যবধানে আমদানি বেড়েছে ২০২ শতাংশ। ব্যবসায়ীদের মতে, এটি মূলত ‘পরীক্ষামূলক আমদানি’ থেকে ধীরে ধীরে ‘নিয়মিত বাণিজ্যে’ রূপ নেওয়ার ইঙ্গিত।
গত ছয় মাসে আমদানির প্রায় ৯৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ এসেছে ভারত থেকে। আমদানিকারকেরা বলছেন, ভারতে পার্সিমনের উৎপাদন বেড়েছে। এ দেশ থেকে আমদানিতে পরিবহন খরচ কম ও সরবরাহ সময় স্বল্প। ফলে ঝুঁকিও তুলনামূলক কম। ফলটি দ্রুত বাজারে আনা যায় এবং দ্রুত বিক্রিও সম্ভব হয়। থাইল্যান্ড থেকে আসা পার্সিমনের অংশ তুলনামূলক কম হলেও তা মূলত উচ্চ দামের একটি সীমিত বাজার ধরে রাখার জন্য আমদানি করা হচ্ছে। তবে ভারত থেকে পার্সিমন আমদানি বাড়ার কারণেই এ দেশে দাম কমছে।
চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মুহাম্মদ আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ফলটি একসময় শুধু সুপারশপগুলোতে বিক্রি হতো। এখন সাধারণ বাজারে বিক্রি হচ্ছে। তবে এখনো সাধারণের নাগালে আসেনি। দেশে উৎপাদন করা সম্ভব হলে দাম কমতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিপদপ্তরের হর্টিকালচার দপ্তরে যোগাযোগ করে জানা গেছে, দেশে এখনো সরকারি ও বাণিজ্যিকভাবে পার্সিমনের চাষ হয় না। তবে যশোর ও বান্দরবানের হর্টিকালচার সেন্টারে কয়েক বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে এ ফলের চাষ হয়েছিল। এখন ফল পাওয়া যাচ্ছে। এর বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশের অনেক এলাকার নার্সারিতে ফলটির চাষ হচ্ছে। চারাও বিক্রি হচ্ছে। তবে মানসম্মত নয়।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, পার্সিমনগাছের উচ্চতা সাধারণত ১৫–৬০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। চারা রোপণের সাত বছরের মাথায় ফল দিতে শুরু করে। কাঁচা ফলের রং গাঢ় সবুজ। পাকতে শুরু করলে উজ্জ্বল হলুদ, কমলা, গোলাপি, ডালিম রং, হালকা লাল ও গাঢ় লাল হতে পারে। রং অনেকটাই নির্ভর করে এর প্রজাতির ওপর। ফলটির দুই হাজারের মতো প্রকরণ আছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মসিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের আবহাওয়া ও মাটি পার্সিমনের কয়েকটি জাতের চাষের জন্য উপযোগী। এটি গাব–জাতীয় ফলের একটি সংস্করণ। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফলটি স্বল্প পরিসরে উৎপাদনের চেষ্টা হচ্ছে। তবে মূল সমস্যা হলো উন্নত মানের চারা পাওয়া যাচ্ছে না। ভারত, থাইল্যান্ড থেকে ভালো মানের চারা আনা গেলে দেশে এ ফলের চাষ করা সম্ভব।