
‘আমরা যখন ভুট্টা খেতে যাই, তখন দেখি একটা তার পড়ে আছে। তখন কারেন্ট ছিল না। আমি ১০ থেকে ১৫ হাত দূরে ভুট্টা তুলছিলাম। কিছুক্ষণ পর শুনি, তারের সঙ্গে লেগে থাকা ভুট্টাগাছের পাতাগুলো পটপট শব্দ করে ফুটতেছে। এ সময় তারের কাছে আমার ভাই জামিদুল ছিল। হঠাৎ করে কারেন্ট (বিদ্যুৎ) এসে ওকে টেনে নিয়ে যায়। রব্বানী আর শাহীনও পড়ে গেল। ওদের তিনজনকেই কারেন্ট টেনে নিয়ে গেছে। আমরা সেখান থেকে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করি। আমার একটা পা কাদাপানির মধ্যে ঢুকে ঝিনঝিন করছিল। পরে কোনোমতে সেখান থেকে দূরে পড়ে যাই। পরে যখন কারেন্ট বন্ধ করে, তার আগেই ছোট ভাইটা ওখানেই মারা গেছে।’
পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন আহত শ্রমিক জয় ইসলাম (৩০)। পঞ্চগড়ে খেতের ভুট্টা তুলতে গিয়ে পড়ে থাকা তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিন শ্রমিকের মৃত্যু নিয়ে তিনি এমন বর্ণনা দিচ্ছিলেন।
এর আগে আজ বুধবার সকাল ১০টার দিকে সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নের ফকিরের হাট বেংহারীপাড়া এলাকায় খেতের ভুট্টা তুলতে গিয়ে পড়ে থাকা তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিনজন শ্রমিক মারা যান। নিহতরা হলেন জামিদুল ইসলাম (২২), গোলাম রব্বানী (৩৫) ও শাহীন আলম (৪০)। তাঁদের বাড়ি পঞ্চগড় সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নের ফকিরের হাট বেংহারীপাড়া এলাকায়। নিহত জামিদুল ইসলাম পঞ্চগড়ের মকবুলার রহমান সরকারি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র। একই ঘটনায় আহত হন জামিদুলের বড় ভাই জয় ইসলাম।
দুপুরে নিহত জামিদুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজন ও প্রতিবেশীদের ভিড়। বাড়ির উঠানে বসে আহাজারি করছেন জামিদুলের বড় বোন মনোয়ারা বেগম। কিছুটা দূরে বসে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে জামিদুলের বাবা সপিজুল ইসলাম বলছিলেন, ‘তুই মোক থুয়ে চলে গেলো রে বাবা, মোর এলা কী হবে। মুই কী নিয়ে বাঁচিম (বাঁচব)।’
বড় বোন মনোয়ারা বেগম বলছিলেন, ‘এক বছর বয়সের এই ভাইটাকে (জামিদুল) রেখে আমার মা মারা গেছিল। আমি ওকে বড় করেছি। আমাদের ভাই–বোনগুলোর মধ্যে সে–ই লেখাপড়া করছে। মানুষের কাজ করে নিজের পড়ালেখার খরচ নিজে জোগাড় করে। আমার স্বামীকে না জানিয়ে ওকে আমি একটা মোবাইল কিনে দিছি, আমার ভাইয়ের মনের আশা পূরণ করেছি। আজকে সেই ভাইটা আমার চলে গেল, আমাদের সব আশা শেষ হয়ে গেল।’
জানা যায়, ফকিরের হাট-বেংহারীপাড়া এলাকায় রবিউল ইসলাম নামের এক কৃষকের ভুট্টাখেতের ফসল তুলে দিতে চুক্তি নিয়েছিলেন ১৪ জন শ্রমিক। ওই ভুট্টাখেতের ওপর দিয়ে বিদ্যুতের সঞ্চালন তার গেছে। সকালে শ্রমিকেরা ভুট্টাখেতে ভুট্টা তুলতে গিয়ে দেখেন, একটি বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে আছে। তবে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। শ্রমিকেরা ভুট্টা তোলার কাজ শুরু করার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে আসে। এতে চারজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। পরে অন্য শ্রমিকদের চিৎকারে স্থানীয় লোকজন এসে তাঁদের উদ্ধারের চেষ্টা করেন। ঘটনাস্থলেই জামিদুল ইসলাম মারা যান। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই গোলাম রাব্বানী ও শাহীন আলমও মারা যান। দুপুরে নিহত তিনজনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছে পঞ্চগড় সদর থানার পুলিশ।
ভুট্টাখেতে বিদ্যুতের তার এল যেভাবে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পঞ্চগড়ে ওই ভুট্টাখেতে পল্লী বিদ্যুতের লাইনের ওপর দিয়ে পড়ে ছিল সাবেক পিডিবির (বর্তমান নেসকো) পরিত্যক্ত লাইনের ছেঁড়া তার। ওই পরিত্যক্ত লাইন অপসারণ না করায় ভুট্টা তুলতে যাওয়া তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি স্থানীয় ব্যক্তিদের। আবার ঘটনার সময় পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে অনুরোধ করা হলেও তারা ওই সময় অবহেলা করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের ১১ হাজার কেভি লাইনটি সব সময়ই সচল থাকে। তাদের কোনো তার ছিঁড়েনি। বরং তাদের তারের ওপর নেসকোর (সাবেক পিডিবির) পরিত্যক্ত লাইনের ঝুলে থাকা তার সরাতে গিয়ে পল্লী বিদ্যুতের তারে লেগে দুর্ঘটনাটি ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অপর দিকে নেসকো বলছে, প্রায় ১৫ বছর আগে যখন পঞ্চগড়ে পাওয়ার গ্রিড ছিল না, তখন এই লাইন দিয়ে ঠাকুরগাঁও থেকে পঞ্চগড় বিদ্যুৎ নিয়ে আসত তৎকালীন পিডিবি। এই লাইনের চুরি হওয়া তারের ঝুলে থাকা কিছু অংশ সরাতে গিয়ে পল্লী বিদ্যুতের তারে লেগে ঘটনাটি ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় নেসকোর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন হবে বলে জানা গেছে।
ঠাকুরগাঁও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ডিজিএম মাজহারুল আলম বলেন, ‘সেখানে আমাদের কোনো তার ছেঁড়া ছিল না। আমাদের ১১ হাজার কেভি লাইনটি সব সময়ই সচল থাকে। আমাদের লাইনের ওপরে পিডিবির যে পরিত্যক্ত লাইটি আছে, সেই লাইনের কিছু তার ঝুলে ছিল। শ্রমিকেরা হয়তো সেই তারগুলো গুছিয়ে সরিয়ে রাখতে গিয়ে আমাদের তারের সঙ্গে লেগে বিদ্যুতায়িত হয়েছে। তবে মুঠোফোনে সংবাদ পাওয়ামাত্রই ওই লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে।’
পঞ্চগড়ের নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি পিএলসির (নেসকো) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী সত্যজিৎ দেব শর্মা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিত্যক্ত লাইনটি পিডিবি নেসকোকে হস্তান্তর করেছে কি না, তা আমার জানা নেই। তবে ওই লাইনের যেসব তার ছিল, তা প্রায়ই চুরি হয়। চুরি হওয়া তারের কিছু অংশ ঝুলে থাকায় শ্রমিকেরা হয়তো সেটা সরাতে গেছেন। এ সময় পল্লী বিদ্যুতের লাইনে লেগে বিদ্যুতায়িত হয়েছেন। তবে বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সেখান থেকে একটি তদন্ত কমিটি হবে।’