
খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের সুন্দরবনঘেঁষা কয়রা নদীর তীরে তখন সুন্দর সকাল। নদীর ওপারে ঘন সবুজে মোড়া বন, এই পারে শান্ত এক গ্রাম। নরম রোদে নদীর কলকল স্রোত যেন মিলেমিশে গেছে পাখির কূজন আর বাতাসের মৃদু ছোঁয়ায়। তীরের ধারে গামছা পেতে বসে আছেন কয়রার বগা গ্রামের মনজিত মণ্ডল। হাতে ছিপ, তাতে চিংড়ি গেঁথে নদীর বুকে ছুড়ে দিলেন বড়শি।
গত মঙ্গলবার সকালে মনজিত হেসে বললেন, ‘এই তো একটু আগে এলাম, এখনো কিছু পাইনি।’ জানালেন, আগের দিন বেশ ভালোই পেয়েছিলেন—কইফুল, কাইন, দাতিনা ও গাগড়া ট্যাংরা। সেই আনন্দে আবার চার কিলোমিটার দূর থেকে চলে এসেছেন।
৬২ বছরের মনজিত মণ্ডল হাতে থাকা বড়শির সুতো দেখিয়ে বললেন, এটাকে বলে প্যারাসুট সুতো। এত মজবুত যে চাইলে একটা মহিষও বাঁধা যাবে। এক কয়েল সুতোর দাম ৪০০ টাকা। ছিপের দাম ১৫০০ আর হুইল মেশিন ১২০০ টাকা। এখন ডিজিটাল যুগ, দামি ছিপ ছাড়া মাছ পড়তে চায় না।
সুন্দরবনের নদীতে আগের চেয়ে মাছ কমে গেছে—কথাটা বলতে গিয়ে মনজিত মণ্ডলের কণ্ঠে ভেসে উঠল আক্ষেপ। বললেন, আগে নদীতে অনেক মাছ পড়ত। এখন ঘন ফাঁসের জাল আর বিষের কারণে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।
মনজিত মণ্ডলের সঙ্গে গল্প শেষে যাওয়া হলো সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া নদী তীরবর্তী হরিহরপুর গ্রামে। সেখানেও দেখা মিলল কয়েকজন ছিপ হাতে বসে আছেন মাছের অপেক্ষায়। বামিয়া গ্রাম থেকে আসা আবদুস সাত্তার সানা বললেন, ‘সকাল থেইকে বড়শিতে দুইটা মাছ ধরার পর আবার ছাড়িয়ে গেছে। কি করব গরিব মানুষ, আমার কাছে তো দামি ছিপ নেই, তাই মাছ তুলতিও কষ্ট হয়। মেশিন লাগানো ছিপি মাছ ধরা সহজ।’
পাশেই গাছের আড়ালে বসেছিলেন একই গ্রামের সুকুমার বিশ্বাস। ভোরে দুজনে একসঙ্গে এসেছেন। বললেন, ‘আজ মাছের ভাবসাব ভালো না। দুইটা দাতিনা আর চারটা পান পাতা মাছ পেয়েছি।’
শাকবাড়িয়া নদীর তীরে দাঁড়িয়ে হরিহরপুর গ্রামের তৃপ্তিরানী স্মৃতিচারণা করে বললেন, ছেলেবেলায় স্কুল ফাঁকি দিয়ে বড়শি নিয়ে মাছ ধরতে যেতেন। তারপর সেই মাছে বনভোজন হতো।
কৃষক মনজিত মণ্ডল, দিনমজুর সাত্তার সানা কিংবা গৃহিণী তৃপ্তিরানী—সবার কথায় এক সুর। বড়শি দিয়ে মাছ ধরা একধরনের নেশা, আনন্দ। সুন্দরবনের নদ–নদীতে মাছ কমে গেছে, নদীতে চলছে বিষ আর ঘন জালের দাপট। তবু সুন্দরবনের পাশের নদীগুলোতে মানুষ ছিপ হাতে মাছের আশায় বসে থাকেন।