ম্যানহোলের ভেতর থেকে উদ্ধার হওয়া নারী নিলুফার ইয়াসমিন। গত শনিবার রাতে তোলা ছবি
ম্যানহোলের ভেতর থেকে উদ্ধার হওয়া নারী নিলুফার ইয়াসমিন। গত শনিবার রাতে তোলা ছবি

ম্যানহোল থেকে ভেসে আসছিল চিৎকার, ঢাকনা খুলে ‘নিখোঁজ’ নারীকে উদ্ধার

হাঁটতে যাচ্ছেন বলে গত বুধবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ময়মনসিংহ নগরীর জেল রোড এলাকার বাড়ি থেকে বের হন নিলুফার ইয়াসমিন (৩৮)। এরপর তিন দিন ধরে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ওই নারীকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ ঘটনায় তাঁর বাবা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এর মধ্যে ম্যানহোলের ভেতর থেকে তাঁকে জীবিত উদ্ধার করে শনিবার মধ্যরাতে বাড়িতে দিয়ে যান কয়েক ব্যক্তি। এ ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও নারীর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, নিলুফার ইয়াসমিন নগরের জেল রোড এলাকায় পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন। তিনি নগরের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষে ২০১৩ সালের দিকে জেলার ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজে প্রভাষক হিসেবে চাকরিও নেন। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ও নবজাতক সন্তানের মৃত্যুর পর মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি। এর পর থেকে মা–বাবার সঙ্গে বসবাস করছিলেন। তাঁর বাবা লিয়াকত আলী বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে হিসাবরক্ষক পদে চাকরি শেষে অবসর জীবন যাপন করছেন।

আজ সোমবার বেলা আড়াইটার দিকে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় নীরবতা। এ সময় নিলুফার ইয়াসমিনকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। তাঁর বাবা লিয়াকত আলী বলেন, বুধবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে তাঁর মেয়ে হাঁটতে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হন। এরপর আর তাঁর খোঁজ না মেলায় বৃহস্পতিবার থানায় একটি জিডি করেন। আশপাশ ও সম্ভাব্য স্থানে খোঁজাখুঁজি করে কোথাও মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছিল না। ওই অবস্থায় শনিবার রাত একটার দিকে কয়েকজন লোক তাঁর মেয়েকে বাসায় দিয়ে যান।

লিয়াকত আলী আরও বলেন, ‘লোকজন জানিয়েছেন, আমার মেয়ে ম্যানহোলের ভেতরে আটকা ছিল। কীভাবে আমার মেয়ে সেখানে পড়েছে তা বলতে পারছি না। আমার মেয়ের মানসিক সমস্যা থাকায় প্রায়ই এভাবে বাসা থেকে বের হয়ে যেত। কিন্তু তিন-চার মাস ধরে ওষুধে কিছুটা সুস্থ থাকায় বাসা থেকে বের হতো না। ওই দিনই বের হয়ে যায়। আমার মেয়ে ম্যানহোলে তিন দিন ধরে না তিন ঘণ্টা ধরে পড়ে ছিল, তা বলতে পারছি না।’

ময়মনসিংহ নগরের জেল রোড এলাকায় ম্যানহোলের ঢাকনাটি খোলে উদ্ধার করা হয় নিলুফার ইয়াসমিনকে

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত শনিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে নগরীর জেল রোড এলাকা থেকে নিলুফার ইয়াসমিনকে উদ্ধার করা হয়। যে স্থানটি থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয় তার পাশে একটি ম্যানহোলে ঢাকনা ছিল না। উদ্ধারের সময় সেখানে ছিলেন ঘটনাস্থলের পাশের বাসিন্দা হারুনুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘রাতে এলাকাটি নীরব হয়ে গেলে এক রিকশাচালক নারীর চিৎকার শুনতে পান। পরে রিকশাচালকের পাশাপাশি আরও কয়েকজন জড়ো হলে আমি বাসা থেকে একটি শাবল নিয়ে ঢাকনা খুলে দেখি ভেতরে নারী। পরে সেখান থেকে তাঁকে বের করা হয়। তাঁর পুরো শরীর ময়লাযুক্ত ছিল। যেখান থেকে ওই নারীকে তোলা হয় তার পাশেই ম্যানহোলে ঢাকনা ছিল না। সেখানে পড়ে গিয়ে হয়তো এ স্থানে চলে আসেন ওই নারী।’

ওই নারীকে উদ্ধারের পর নিজের বাসায় নিয়ে যান মোহাম্মদ মাসুদ নামের এক বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘ম্যানহোলের ঢাকনা না থাকায় ওই নারী ভেতরে পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলছেন, ম্যানহোলের ভেতরে দুই দিন আটকা ছিলেন। তাঁর হাত-পা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। রাত ১২টার দিকে ম্যানহোল থেকে তুলে আমার বাসায় নিয়ে গরম পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দুধ খাওয়াই। পরে নারীকে কয়েকজন চিনতে পারলে তাঁর বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়।’

এমন ঘটনা শোনার পর সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুমনা আল মজীদ, সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম মিঞাসহ কয়েকজন কর্মকর্তা। পরে তাঁরা ওই নারীর পরিবারের সঙ্গেও কথা বলেন।

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুমনা আল মজীদ বলেন, ‘দুর্ঘটনাস্থল আমরা পরিদর্শন করেছি। আমরা বর্জ্য শাখার কর্মচারী দিয়ে দেখেছি, ম্যানহোলের গভীরতা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কোমর পর্যন্ত। কিন্তু ড্রেনে পড়ে গিয়ে হেঁটে বেড়ানো, তিন দিন বা এক দিন আটকে থাকা, সেই পরিস্থিতি নেই। মানুষ হেঁটে বেড়াতে পারবে, এমন গভীরতার ড্রেন সিটি করপোরেশন এলাকায় নেই।’

গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে নগরের বিভিন্ন ড্রেনের ঢাকনা চুরি হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ঢাকনাগুলো পুনঃস্থাপন করে দিচ্ছি এবং পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। মূল সড়কের চেয়ে অলিগলির ঢাকনাগুলো বেশি চুরি হয়। পুলিশ যদি তদন্ত করে, ভাঙারি দোকানগুলোকে নজরদারিতে আনে তাহলে ড্রেনের ঢাকনা চুরি রোধ করা যেতে পারে।’