
সকালের আলো তখনো পুরোপুরি ফোটেনি। সুন্দরবনের পাটকোষ্টা টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলী হোসেন টহল দল নিয়ে নৌকায় নদী ঘুরছিলেন। হঠাৎ খালের ধারে ফিসফিস শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ান। আওয়াজ ধরে সাবধানে এগোতেই দেখা মেলে, একটি নৌকায় কয়েকজন জেলে গুইসাপ কেটে কাঁকড়া ধরার ফাঁদ তৈরি করছেন। বনরক্ষীরা কাছাকাছি পৌঁছাতেই তাঁরা পালিয়ে যান। জব্দ করা হয় ফেলে যাওয়া নৌকা ও গুইসাপের মাংস।
ঘটনাটি ঘটেছে আজ রোববার সকালে। পাটকোষ্টা টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এক দিন আগেও সুন্দরবনের শতমুখী খাল থেকে অবৈধভাবে বনে ঢুকে গুইসাপের মাংস দিয়ে কাঁকড়া ধরার সময় পাঁচজনকে আটক করা হয়েছিল। আটক জেলেদের মধ্যে রয়েছেন কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার তৈয়ব আলী, শ্যামনগরের গাবুরা এলাকার আলমগীর গাজী, আবদুল জলিল, সেলিম হোসেন ও আনোয়ার হোসেন।
তবে শুধু কাঁকড়া ধরার জন্য গুইসাপ শিকারই নয়, সুন্দরবনে অবৈধভাবে প্রবেশ করে বিষ দিয়ে মাছ ধরা ও হরিণ শিকারের ঘটনাও সম্প্রতি বেড়েছে। গতকাল শনিবার জোংড়া ফাঁড়ির বনরক্ষীরা হেঁটে টহল দেওয়ার সময় ২০০ ফুট লম্বা হরিণ শিকারের ফাঁদ উদ্ধার করেন। তবে শিকারি বা নৌকা ধরা পড়েনি। এর এক দিন আগে হরমল খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরার সময় পাঁচজনকে আটক করা হয়েছিল। পৃথক অভিযানে সুন্দরবনের পানিরঘাট এলাকা থেকে ৯ বোতল বিষসহ আটক করা হয় দুজনকে।
সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল বনজীবীরা জানান, তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে ১ সেপ্টেম্বর থেকে সুন্দরবনের দ্বার খুলতেই বৈধ অনুমতিপত্র নিয়ে হাজারো জেলে মাছ ও কাঁকড়ার সন্ধানে প্রবেশ করেছেন। তবে এর ভেতরেই জেলের ছদ্মবেশে ঢুকে পড়ছে একদল অনুপ্রবেশকারী, যারা নিয়ম মানছে না; বিষ দিয়ে নদী-খাল উজাড় করছে, ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রকৃত জেলেরা, আর প্রতিদিন বেড়ে চলা এ অনুপ্রবেশ সুন্দরবনের সুরক্ষা ও স্থানীয় জীবিকাকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলছে।
৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে কয়রার তেঁতুলতলা গ্রামে দেখা গেল আরেক দৃশ্য। মোটরসাইকেলে করে হরিণের মাংস নিয়ে যাচ্ছিলেন কয়েকজন শিকারি। স্থানীয় লোকজন বিষয়টি টের পেয়ে পথ রোধ করলে শিকারিরা ব্যাগভর্তি মাংস ফেলে পালিয়ে যায়। ব্যাগ খুলতেই বেরিয়ে আসে প্রায় ১২ কেজি হরিণের মাংস। পুলিশ পরে ঘটনাস্থল থেকে মাংসগুলো উদ্ধার করে।
এ বিষয়ে সুন্দরবন–সংলগ্ন এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বন বিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিনিয়ত সুন্দরবনে ঢুকছে অপরাধীরা। লোকালয়ে এসে মাংস ধরা পড়ছে, অথচ বনের ভেতর প্রতিদিন কত হরিণ মারা হচ্ছে, তা কারও জানা নেই। প্রশাসন আরও দায়িত্বশীল না হলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ দিনে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় অভিযানে ৫১ জন অনুপ্রবেশকারীকে আটক করেছেন বনরক্ষীরা। জব্দ হয়েছে একাধিক নৌকা-ট্রলার, জাল, ৩৪০ কেজি মাছ, ৯০ কেজি কাঁকড়া ও বিষের বোতল। উদ্ধার হয়েছে হরিণ শিকারের জন্য পাতা এক হাজারের বেশি ফাঁদ।
সুন্দরবন–সংলগ্ন কয়রার জেলে আবু মুসা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা যদি সামান্য ভুল করি, তাইলে আমাগের বনে ঢোকার লাইসেন্স বাতিল হয়। কিন্তু যারা অবৈধভাবে ঢুকতিছে, তাগের ভয়ের তেমন কিচ্ছু নেই। ধরা পড়লিও অল্প দিনেই আবার মুক্তি পাইয়ে বনে নামে। অল্প সময়ে বেশি মাছ ধরতি ওরা বিষ মারে। এতে মাছ, কাঁকড়া সব শেষ। ওগের জন্যি আমরাও পথে বসতি যাচ্ছি। সুন্দরবনে অবৈধ প্রবেশ বন্ধ না হলি আমাগের বনে গিয়ে লাভ হবে না।’
উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব সাইফুল ইসলামের ভাষ্য, সুন্দরবন শুধু মাছ-কাঁকড়ার ভান্ডার নয়, মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। অনুপ্রবেশকারীরা যদি এভাবে বিষ মেরে নদী-খাল উজাড় করে ও হরিণ শিকার চালিয়ে যায়, তবে একদিন এই অমূল্য সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাবে। সুন্দরবন রক্ষায় এখনই সবার আন্তরিক পদক্ষেপ জরুরি।
পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, ‘সীমিত জনবল নিয়েও আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। স্মার্ট টহল টিমের পাশাপাশি হেঁটে বিশেষ টহল চলছে। অনুপ্রবেশকারীদের নৌকা, জাল ও ফাঁদ বেশি উদ্ধার হচ্ছে। তবে গভীর বনে হাতেনাতে ধরা কঠিন। ভবিষ্যতে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দায়িত্বে অবহেলা প্রমাণিত হলে বনকর্মীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা হবে।’