দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ি এলাকায় খালেদা জিয়ার পৈতৃক নিবাস তৈয়বা ভিলা। এখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। আজ মঙ্গলবার সকালে তোলা
দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ি এলাকায় খালেদা জিয়ার পৈতৃক নিবাস তৈয়বা ভিলা। এখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। আজ মঙ্গলবার সকালে তোলা

প্রতিবেশী বললেন

খালেদা জিয়া দিনাজপুরে এলে সবাই ভিড় করতেন, তিনি সবার কথা শুনতেন

দীর্ঘ লড়াই–সংগ্রামের রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটিয়ে না–ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আজ মঙ্গলবার সকাল ছয়টার দিকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে তাঁর পৈতৃক নিবাস দিনাজপুরে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে দলীয় নেতা-কর্মীরা ছুটে আসেন শহরের জেলমোড় এলাকার দলীয় কার্যালয়ে। সকাল থেকে শহরের প্রায় সব জায়গায় খালেদা জিয়াকে ঘিরেই চলছে নানা স্মৃতিচারণা ও আলোচনা। দলীয় কার্যালয়ে ও বালুবাড়ির পৈতৃক নিবাসে কোরআন তিলাওয়াতের আয়োজন করা হয়েছে।

খালেদা জিয়ার বাবার বাড়ি দিনাজপুরের বালুবাড়ি এলাকায়। তাঁর বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ও মা তৈয়বা মজুমদার। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে খালেদা জিয়া তৃতীয়। তাঁর ডাকনাম ছিল পুতুল। বালুবাড়ি এলাকায় তৈয়বা ভিলা বাড়িতেই কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলো। বর্তমানে সেই বাড়িতে তাঁর কেউ বসবাস করেন না। সেখানে একটি বেসরকারি হাসপাতালের কার্যক্রম চলে। মঙ্গলবার তৈয়বা ভিলার সামনে জড়ো হয়েছেন স্থানীয় মানুষ, দলীয় নেতা-কর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীরা।

খালেদা জিয়ার প্রতিবেশী শওকতুল্লাহ বাদশা (৫২) প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ছোট ছিলাম। এই বাড়িতে তাঁর অবস্থানের সময়গুলো সেভাবে বলতে পারব না। তবে বড়দের কাছে শুনেছি, তিনি মিশুক প্রকৃতির ছিলেন। বড় হয়েও কয়েকবার দেখেছি যখন দিনাজপুরে আসতেন বাড়িতে। দলীয় নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি প্রতিবেশীরাও ভিড় করতেন। সবার কথা শুনতেন।’ জানালেন, সবশেষ ২০১২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর একবার দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ ময়দানে এক জনসভায় এসেছিলেন খালেদা জিয়া। এর আগে ২০০৮ সালে মায়ের মৃত্যুর সময় একবার দিনাজপুরে এসেছিলেন।
পাঁচ বছর বয়সে দিনাজপুর মিশন স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু হয় খালেদা জিয়ার। এরপর ১৯৬০ সালে ভর্তি হন দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে। সেখানেই তাঁর শিক্ষাজীবন কাটে।

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমা ইয়াসমিন বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া দিনাজপুরের গর্ব, দেশের গর্ব। আমরা গর্ব করে বলি, তিনি এই বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। প্রথম নারী হিসেবে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। দেশ আজকে একজন অভিভাবক হারাল। এই সময়ে দেশের জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল।’

রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে দিনাজপুরে থাকেন খালেদা জিয়ার আপন খালাতো ভাই আবু তাহের (৫৫)। বোনের মৃত্যুসংবাদ শুনে তিনি ইতিমধ্যে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক। নিজের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তিনি ছিলেন খুবই আন্তরিক। তিনি বাসায় এলে সবার কথা শুনতেন। আজ সবই স্মৃতি হয়ে গেল।’

খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর পেয়ে দলীয় কার্যালয়ে জড়ো হচ্ছিলেন নেতা-কর্মীরা। আজ মঙ্গলবার সকালে দিনাজপুর শহরের জেলমোড় এলাকায়

দিনাজপুর-৩ আসন থেকে প্রথমবারের মতো ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। গত ২৮ ডিসেম্বর জেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ দলীয় নেতা-কর্মীরা তাঁর পক্ষে মনোনয়নপত্র জমাও দিয়েছিলেন। দিনাজপুর-৩ আসনে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণের কথা শুনে এককাট্টা হয়েছিলেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রিয় নেত্রীর পক্ষে প্রচারণাও চালিয়েছেন।

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে জেলা বিএনপির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। সবশেষ গত মাসের ৯ তারিখে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রিয় নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। বরাবরের মতোই তাঁর শিশুসুলভ আচরণ দেখেছি। দিনাজপুরের মানুষ তাঁকে প্রার্থী হিসেবে পেয়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত ছিলেন। দিনাজপুরের উন্নয়নে স্বাক্ষর রেখে গেলেন। জাতির বড় প্রয়োজনের সময় আমরা তাঁকে হারালাম। এই দেশ, এই জাতির ইতিহাসে তিনি কিংবদন্তি।’

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়ে সাবেক পৌর মেয়র ও ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে দিনাজপুর-৩ আসনে দলের নির্দেশে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে নেত্রীর সঙ্গে অনেক স্মৃতি। আমার পরিবারের খোঁজ রেখেছেন তিনি। আমাকে স্নেহ করে “পাগলা” বলে ডাকতেন। ২০১১ সালে প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হয়ে যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম, আমাকে দেখে বললেন, “পাগলা তোর কী খবর?” তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, জনগণের সঙ্গে থাকতে হবে। রাজনীতিতে এটাই বড় শক্তি। আজ আমরা অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়লাম।’