
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ছিলেন। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে কখনো আপস করেননি। দুঃসময়েও তিনি গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থান নিয়েছিলেন। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে তিনি সংগ্রাম করেছিলেন। তরুণ প্রজন্মকে তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে।
আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় সমাজকল্যাণ ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ এভাবেই স্মৃতিচারণা করেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সবার ভেতর আলো জ্বেলেছেন—এমন মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। তাঁদের সুস্থ করতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের খালি হাতে খালি পায়ে গ্রামে ফিরে যেতে হয়েছিল। দেশটাও গত ৫০ বছরে গড়েই উঠল না। গণতন্ত্র, সাম্য, সমাজতন্ত্র, ন্যায়বিচার—সবই আড়ালে থেকে গেল। আমাদের রাজনীতি নিশ্চয় ত্রুটিপূর্ণ ছিল। সেই রাজনীতি ভুল ছিল বলেই চব্বিশ ঘটেছে।’
শারমীন এস মুরশিদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সংস্কৃতি বিরাজমান, সেটির পরিবর্তন ঘটেনি। তরুণদের এই শিক্ষাটা মাথায় রাখতে হবে। পেছনের পচে যাওয়া প্রথাগুলো গ্রহণ করে রাজনৈতিক দল গড়তে চাইলে ভুল হবে। আদর্শের জায়গায় দাঁড়াতে হবে। এ জন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পথ অনুসরণ করতে হবে।
চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের উদ্যোগে ওই স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। এই সভার মাধ্যমে গতকাল সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। সভায় উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাদের হৃদয়ে বিচিত্র রেখা এঁকে গেছেন। তিনি ছিলেন আমাদের বটবৃক্ষ। দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। এই বিষয়টি তরুণ প্রজন্মের কাছে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে অক্ষয় অমর করে রাখবে।’
উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, ‘চট্টগ্রামবাসী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্মরণসভায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিলেন। হল কানায় কানায় পূর্ণ থেকে তাঁর প্রতি সবাই যেভাবে শ্রদ্ধা জানালেন, এতে বলতেই হয় তিনি অমর। বর্তমান সরকার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পথ অনুসরণ করেই কাজ করছে।’
স্মরণসভায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে পুরোপুরি ভুয়া নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদ কায়েমের আনুষ্ঠানিক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। বলা চলে ওই বছরই ফ্যাসিবাদের প্রকাশ ঘটেছিল। ২০১৫ সালের পর থেকে রাজনৈতিক সংগ্রামকে একটা ঐক্যের জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো। অন্যদিকে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা, জাগরণ ঘটানো এবং ফ্যাসিবাদের পতনের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার তাগিদটা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি ছিলেন ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু।
জোনায়েদ সাকি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে রাজনীতিতে হতাশা নেমে এসেছিল। ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর আগের রাতে ভোট হয়ে গেল, তারপর বিএনপির মতো দল ছয়টি আসন নিয়ে সংসদে থাকতে হলো; এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় আকারের হতাশা নেমে এসেছিল। ২০১৯ সালে বড় আকারের কোনো রাজনৈতিক সংগ্রাম দানা বাঁধেনি। বিএনপিও তখন চিন্তা করছিল, কীভাবে সংগ্রামের পথ অনুসন্ধান করা যাবে। সে রকমই এক সময়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলেন। শেষনিশ্বাস ত্যাগ করার আগপর্যন্ত তিনি আন্দোলনে ছিলেন।
স্মরণসভায় বক্তব্য দেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সহধর্মিণী নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরিন পারভিন হক। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে কাটানো নানা মুহূর্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, জাফরুল্লাহ সব সময় নারীর অগ্রগতি চাইতেন। নারীরা স্বাবলম্বী হবে, শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াবে, স্বাধীনভাবে কথা বলবে—এমনটাই চাওয়া ছিল তাঁর। অবশ্য এই সবকিছু তিনি সবার জন্যই চাইতেন। বাক্স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে চলাফেরার মৌলিক অধিকারের পক্ষে তিনি লড়াই করে গেছেন।
চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক শেখ মোজাফফ্র আহমদের সভাপতিত্বে ও সদস্যসচিব ফাহিম শরীফ খানের সঞ্চালনায় স্মরণসভার আলোচনায় অংশ নেন সিটি মেয়র শাহাদাত হোসেন, চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতালের ট্রাস্টি রবিউল হোসেন, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম প্রমুখ। এ ছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও বক্তব্য দেন।