সাগরে ইলিশ ধরা পড়ায় চার মাস পর এই ঘাটজুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশের দেখা মিলেছে। ঘাটের পাশেই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে চলছে জেলেদের ব্যস্ততা। কেউ মাছ নামাচ্ছেন, কেউ বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। এক ট্রলার থেকেই ৩৮ লাখ টাকার ইলিশ বিক্রি করতে দেখা গেছে।
সমুদ্রের পাড় থেকে ভেসে আসছে জেলেদের হাঁকডাক। কিছুক্ষণ আগেই গভীর সাগর থেকে ঘাটে ভিড়েছে পাঁচটি ট্রলার। প্রতিটিতেই ধরা পড়েছে বড় ইলিশ। সঙ্গে রয়েছে নানা রকম সামুদ্রিক মাছ।
আজ রোববার সকালে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটা ফিশারিঘাটে গিয়ে দেখা যায় এই চিত্রের। সাগরে ইলিশ ধরা পড়ায় চার মাস পর ঘাটজুড়ে এখন উৎসবমুখর পরিবেশ। ঘাটের পাশেই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে চলছে জেলেদের ব্যস্ততা। কেউ মাছ নামাচ্ছেন, কেউ বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। এক ট্রলার থেকেই ৩৮ লাখ টাকার ইলিশ বিক্রি করেছেন জেলেরা।
জেলে ও পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘ চার মাস সাগরে ইলিশ ধরা পড়েনি। তবে গত বৃহস্পতিবার থেকে ট্রলারে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ ধরা পড়ছে। সামনেও আরও বাড়বে বলে তাঁদের আশা। তবে বঙ্গোপসাগর এখনো কিছুটা উত্তাল রয়েছে। সাগরে নিম্নচাপ অথবা লঘুচাপ সৃষ্টি না হলে আগামী কয়েক মাস বেশি মাত্রায় সাগরে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ ধরা পড়বে। টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়াসহ জেলায় মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে পাঁচ হাজার। এসব ট্রলারে কাজ করেন ১ লাখ ১২ হাজার শ্রমিক।
‘ইলিশের দাম বেশি। স্থানীয় বাজারে এই দামে বিক্রি করা সম্ভব নয়। কিছুদিন পর দাম কমলে এসব বাজারে ইলিশ পাওয়া যাবে।’রফিক উল্লাহ, খুচরা ব্যবসায়ী
ইলিশ ধরা পড়লেও দাম কমেনি। সকাল থেকেই পাইকারেরা এই ঘাটে ভিড় করেছেন। এসব মাছ ঢাকায় পাঠাতে ট্রাক নিয়েও হাজির হয়েছেন অনেকে। জানতে চাইলে ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আবহাওয়া কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় দুই শতাধিক ট্রলার সাগরে গেছে। কিছু কিছু ঘাটে ফিরছে ইলিশ নিয়ে। তবে দাম বেশি হওয়ায় স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা ঢাকায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন।’
এক ট্রলারে ৩৮ লাখ টাকার ইলিশ
কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুলের একটি ট্রলারের জালে ধরা পড়েছে ৩ হাজার ২২২টি ইলিশ। এর মধ্যে ৩ হাজার ইলিশ ৩৮ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন জেলেরা। বাকি ইলিশ জেলে ও ট্রলার মালিক ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। ট্রলারের মাঝি আমিন উল্লাহ (৪৫) ও জেলে সাইফুল ইসলাম (৫০) বলেন, উপকূল থেকে অন্তত ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার গভীর সাগরে গিয়ে তাঁরা জাল ফেলে ইলিশগুলো ধরেছেন। ঘাট থেকে সাগরের ওই এলাকায় পৌঁছতে তাঁদের সময় লেগেছে ২১ ঘণ্টা। তারপর টানা দুই দিন জাল ফেলে ইলিশগুলো ধরেছেন।
অবশ্য শুধু এই ট্রলার নয়। পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার জসিম উদ্দিনের একটি ট্রলারে ধরা পড়েছে ১ হাজার ২০০ ইলিশ। তিনি এসব ইলিশ বিক্রি করে পেয়েছেন ১৯ লাখ টাকা। পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের নুনিয়াছটার বাসিন্দা ফজল কাদেরের ট্রলারে ছিল ১ হাজার ১০০টি ইলিশ। তিনি এসব বিক্রি করে পেয়েছেন ১২ লাখ টাকা। ট্রলারের মাঝি আবুল মনছুর বলেন, গভীর সাগরে ইলিশের দেখা মিলছে; কিন্তু ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা ট্রলার চালিয়ে গভীর সাগরে যাওয়ার সক্ষমতা অধিকাংশ ট্রলারের নেই। কক্সবাজারের ৩ হাজারের মতো ট্রলার রয়েছে, যেটি দিয়ে উপকূল থেকে দূরে গিয়ে মাছ ধরতে পারে।
পাইকারি বাজারেই বাড়তি দাম
সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে অবস্থান করে দেখা গেছে, ৮০০ গ্রাম থেকে ১২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার টাকায়। আর ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ইলিশ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১ হাজার ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। ছোট ইলিশ কেজিতে বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায়। স্থানীয় পাইকারেরা এসব মাছ কেনা থেকে বিরত থাকছেন। ঢাকা থেকে বিভিন্ন পাইকার এসে এসব মাছ সংগ্রহ করে নিচ্ছেন।
মাছ কিনতে আসা খুচরা ব্যবসায়ী রফিক উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ইলিশের দাম বেশি। স্থানীয় বাজারে এই দামে বিক্রি করা সম্ভব নয়। এ কারণে শহরের বাহারছড়া বাজার, কানাইয়ার বাজার, বড় বাজার, কালুরদোকান বাজারে ইলিশ নেই। কিছুদিন পর দাম কমলে এসব বাজারে ইলিশ পাওয়া যাবে।
৮০০ থেকে ১২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার টাকায় আর ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১ হাজার ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়।
কক্সবাজার মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, ঘাট থেকে গত শুক্রবার ৪০০ কার্টন ইলিশ ঢাকাতে পাঠিয়েছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। প্রতিটা কার্টনে ইলিশ ছিল ২০ কেজি। শনিবার সরবরাহ করা হয় ৮০০ কার্টন ইলিশ। আজ রোববার বেলা ১১টা পর্যন্ত ৫০০ কার্টন ইলিশ পাঠানো হয়েছে। আরও ৬০০ থেকে ৭০০ কার্টন ইলিশ সরবরাহ করা হতে পারে।
জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, চলতি বছর ১২ জুন সাগরে মাছ ধরায় ৫৮ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছিল। তখন সাগরে নামার জন্য পাঁচ হাজার ট্রলার প্রস্তুতি নিয়েছিল। তবে গভীর নিম্নচাপের কারণে সাগর উত্তাল হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। তবে এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক। এমন পরিস্থিতিতে গভীর সাগরের ইলিশ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও টেকনাফ উপকূলের দিকে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, গত বছর জেলায় মাছ উৎপাদিত হয়েছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ইলিশ ছিল ৩৫ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। চলতি বছর এ জেলায় ৩৬ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।