
১৮ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর দেশের খ্যাতিমান ৯ জন নবীন-প্রবীণ শিল্পী রংতুলি নিয়ে জড়ো হয়েছিলেন চট্টগ্রামের ফিনলে পাহাড়ে। বাদশা মিয়া সড়কের পাশ ঘেঁষে উঠে যাওয়া বর্ষাস্নাত পাহাড়ি প্রকৃতি যেন চারটি দিন মুখর হয়ে উঠেছিল শিল্পীদের সৃজন-আনন্দে।
শিশুর মুখ আঁকেন শিল্পী মোহাম্মদ ইকবাল। নানা দেশের নানা জাতি-সম্প্রদায়ের শিশুর মুখ। সেই শিশুদের অভিব্যক্তি করুণ, বিষণ্ন, ভীত ও বেদনার্ত। এই অভিব্যক্তি যেন জানিয়ে দেয়, আমাদের পৃথিবীটা ভালো নেই। এর শুশ্রূষা দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক শিল্পী মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, ‘আনন্দিত শিশুর মুখ আমি আঁকতে চাই, কিন্তু যখনই সংবাদমাধ্যমে গাজা, সিরিয়া বা মিয়ানমারের শিশুদের ছবিগুলো দেখি, তখন আমার ক্যানভাসের শিশুটির মুখে আর হাসি ফোটে না।’
১৮ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর দেশের খ্যাতিমান ৯ জন নবীন-প্রবীণ শিল্পী রংতুলি নিয়ে জড়ো হয়েছিলেন চট্টগ্রামের ফিনলে পাহাড়ে। বাদশা মিয়া সড়কের পাশ ঘেঁষে উঠে যাওয়া বর্ষাস্নাত পাহাড়ি প্রকৃতি যেন চারটি দিন মুখর হয়ে উঠেছিল শিল্পীদের সৃজন-আনন্দে। ১৮ সেপ্টেম্বর উদ্বোধনী পর্বের পর সন্ধ্যাটা কেটে গিয়েছিল গল্প–আড্ডা–গান আর পানাহারে। নগরের বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন সেই আসরে। পরদিন সকালে শুরু হয়েছিল মূল পর্ব। রংতুলি–ক্যানভাসে নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলেন শিল্পীরা।
আনন্দিত শিশুর মুখ আমি আঁকতে চাই, কিন্তু যখনই সংবাদমাধ্যমে গাজা, সিরিয়া বা মিয়ানমারের শিশুদের ছবিগুলো দেখি, তখন আমার ক্যানভাসের শিশুটির মুখে আর হাসি ফোটে না।—অধ্যাপক মোহাম্মদ ইকবাল, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোহাম্মদ ইকবাল যেমন আঁকেন শিশুদের মুখ, তেমনি শিল্পী জামাল আহমদের ক্যানভাসে শুধু কবুতর। কখনো এই পাখিদের স্থির অলস দুপুর, কখনোবা উড়ে যাওয়ার অপূর্ব গতির ভঙ্গিমা। আবার শিল্পী কনকচাঁপা চাকমার ছবিতে উঠে আসে পাহাড়ি ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জীবনের নানা অনুষঙ্গ।
একেকজন শিল্পী একটি নির্দিষ্ট বিষয়কেই কেন শিল্পের উপজীব্য করে তোলেন—এ কৌতূহল জেগেছিল মনে। জামাল আহমেদ বললেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় থাকার সময় একবার আমার বাড়ির জানালায় ঝপ করে এসে পড়েছিল একটি কবুতর। তাড়া খেয়ে এসেছিল বোধ হয়। পাখা ছড়িয়ে জানালার কাচ আঁকড়ে পড়ে থাকার ভঙ্গিটি আমাকে খুব আক্রান্ত করেছিল। জানালার আকৃতি ছিল প্রায় আমার ক্যানভাসের সমান মাপের। রংতুলি হাতে নেওয়ার আগেই ছবিটা যেন আমি দেখতে পেয়েছিলাম মানসচক্ষে। ছবিটি আঁকার পর খুব প্রশংসিত হয়েছিল সেখানে। সেই থেকে কবুতরের ছবি আঁকছি...নানা বর্ণ ও বৈচিত্র্যের কবুতর।’
বিষয়বৈচিত্র্যে যেমন, সৃষ্টির নৈপুণ্যেও প্রাণ পেয়েছিল চিত্রকর্মগুলো। যেমন আবদুল্লাহ আল বশীরের আঁকা ছবিটি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে করোনাকালে আমাদের স্তব্ধপ্রায় বিপন্ন সময়গুলোর কথা। আনিসুজ্জামান আনিসের প্রেমিক যুগলের ছবির মধ্যে ছিল ভালোবাসার বার্তা।
কনকচাঁপা চাকমা বললেন, তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাঙামাটিতে। শৈশব থেকে পাহাড়ি মানুষ ও সমাজের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয়। সেই জীবনটাকে তিনি তুলে ধরতে চান।
বিশ্বজিৎ গোস্বামীর ক্যানভাসের সামনে থমকে দাঁড়াতে হলো। পিঠ ও কোমর পর্যন্ত সুগঠিত এক পুরুষের পৃষ্ঠদেশের বলিষ্ঠতা তুলে ধরেছেন তিনি। বিষয়বৈচিত্র্যে যেমন, সৃষ্টির নৈপুণ্যেও প্রাণ পেয়েছিল চিত্রকর্মগুলো। যেমন আবদুল্লাহ আল বশীরের আঁকা ছবিটি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে করোনাকালে আমাদের স্তব্ধপ্রায় বিপন্ন সময়গুলোর কথা। আনিসুজ্জামান আনিসের প্রেমিক যুগলের ছবির মধ্যে ছিল ভালোবাসার বার্তা। সৌরভ চৌধুরীর চিত্রকর্মে প্যাঁচা, তাস, ধাতব মুদ্রা ইত্যাদির প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উঠে এসেছে জীবন ও জুয়া। আশরাফুল হাসানের আঁকা ছবিতে দুই নারীকে দেখতে পাই। একজনের পরনে সংবাদপত্রের আদলে একটি শাড়ি, অন্যজনের পরনে সম্পূর্ণ কালো আবরণ। প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত সংবাদের প্রতীক হিসেবে এই দুই নারী উপস্থাপিত। শেখ মোহাম্মদ রোকনুজ্জামানের ছবিতে দেখা যায়, এলোমেলোভাবে রাখা কিছু মোটরসাইকেলের চারপাশে অস্পষ্ট কিছু রেখা। এই রেখাগুলোকে ব্যক্তিগত আবেগের সঙ্গে তুলনা করেছেন চিত্রকর।
শিল্পীদের জড়ো করার উদ্যোগটি নিয়েছিলেন তারিকুল ইসলাম নামের একজন শিল্প সমঝদার ও পৃষ্ঠপোষক। বেশ কয়েক বছর ধরে ফিনলে পাহাড়ের ঢালে তাঁর বাড়ির আঙিনা এভাবে মুখর হয়ে ওঠে শিল্পীদের আগমনে ও শিল্পচর্চায়।