
বিকেল নামলেই হাওরপারের গ্রামগুলো চঞ্চল হয়ে ওঠে এক ভিন্ন ব্যস্ততায়। ঘরের কাজকর্ম শেষ করে অনেকেই তখন নৌকা নিয়ে ভেসে যান হাওরের বুকে। কেউ সারা রাত ভেসে থাকেন পানিতে, কেউ আবার ফাঁদ পেতে রেখে সন্ধ্যার পর ফিরে আসেন বাড়ি। তবে ভোর হওয়ার আগেই আবার ছুটে যান ফাঁদ সংগ্রহ করতে। এই ব্যস্ততার মূল কারণ চিংড়ি, যাকে স্থানীয় লোকজন বলেন ‘ইছা মাছ’।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের কাদিপুর আর রাজনগর উপজেলার অন্তেহরি গ্রামের শতাধিক পরিবার বর্ষাকালে এই হাওরে চিংড়ি ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁদের প্রধান ভরসা ‘কিরণমালা’ নামে পরিচিত এক বিশেষ ফাঁদ। প্লাস্টিকের তৈরি এই ফাঁদে টোপ দেওয়া থাকে মাছের খাদ্য। টোপের আকর্ষণে চিংড়ি ঢুকে পড়ে ফাঁদের ভেতরে। তাঁরা নৌকা বোঝাই করে এই ফাঁদ নিয়ে হাওরে যান। তবে এখানে অন্য মাছশিকারিরাও আছেন, যাঁরা জাল ও বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন।
গত শুক্রবার বিকেলে কাউয়াদীঘি হাওরপারের কাদিপুর ব্রিজের কাছে চোখে পড়ে চিরচেনা দৃশ্য। গ্রামের বেশ কিছু মানুষ এসে জড়ো হয়েছেন। কেউ গল্পে মশগুল, শিশুরা ছুটছে ‘ভেট’ (শাপলা ফল) কুড়াতে, হাঁস ভাসছে হাওরের পানিতে। হঠাৎই যেন পাল্টে গেল দৃশ্যপট। গ্রামের খাল বেয়ে দু–একটা করে নৌকা বেরিয়ে আসতে লাগল। প্রতিটি নৌকাবোঝাই কিরণমালা ফাঁদ। সন্ধ্যা ঘনাতেই অন্তেহরির ভেতর থেকে আরও নৌকা হাওরের দিকে ছুটতে লাগল। আবার কিছু জেলে মাছ ধরে নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। তাঁদের চেহারায় সারা দিনের রোদে পোড়া ক্লান্তি।
এ সময় ছাইরঙা মেঘ উড়ে আসে আকাশে, সঙ্গে শরীর জুড়ানো হালকা ঝোড়ো শীতল বাতাস। হাওরের বিশাল বুকে তৈরি হয়েছে আফাল (ঢেউ)। আফালের কারণে চিংড়িশিকারিদের অনেকে পাড়ে নৌকা ভিড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। এ সময় কাদিপুর গ্রামের কৃপেশ সরকার বলেন, ‘আফাল কমলে হাওরে যাইমু। আমরা শুধু ইছা মাছ মারি। তবে কেউ আছে জাল দিয়া মাছ মারে, কেউ আছে বড়ি (বড়শি) দিয়া মাছ ধরে। বর্ষাকালে আমরার ভালাই চলে।’
কৃপেশ সরকার জানালেন, তাঁর ৬০০টি কিরণমালা ফাঁদ আছে। ঢাকার বাজার থেকে কিনেছেন, ১০০ পটের (ফাঁদ) দাম চার হাজার টাকা। প্রতিদিন এসব ফাঁদে দুই থেকে চার কেজি পর্যন্ত চিংড়ি ধরা পড়ে। কখনো আরও বেশি। পাইকারি দরে প্রতি কেজি চিংড়ি বিক্রি হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। আষাঢ় থেকে কার্তিক পর্যন্ত এভাবেই চলে চিংড়ি শিকার। তবে বর্ষা মৌসুমে সংসার চলে ভালোভাবে। শুকনা মৌসুমে ইজারার কারণে মাছ ধরতে পারেন না, তাই রোজগারও থাকে না।
কাদিপুর গ্রামের বনমালি সরকার জানালেন, তিনি ৩০০টি ফাঁদ নিয়ে হাওরে যাচ্ছেন। যে যার সুবিধামতো হাওরের পানিতে ফাঁদগুলো পেতে রাখেন। কেউ কাছাকাছি ফাঁদ ফেলে রাতে ফিরে আসেন, আবার কেউ হাওরের অনেকটা ভেতরে চলে যান। হাওরেই রাত কাটান।
একই গ্রামের ইরালাল সরকারসহ স্থানীয় কয়েকজন বললেন, মাছ ধরা তাঁদের পেশা। বর্ষা এলে মাছ ধরেই তাঁদের সংসার চলে। প্রতিদিন শতাধিক নৌকা হাওরে নামে শুধু চিংড়ির টোপ ফেলতে।
আফাল কমে এলে জেলেরা নৌকা নিয়ে হাওরে চলে যান। ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। জেলেদের বুকে নিয়ে তখন ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে কাউয়াদীঘি হাওর।