রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামে নবান্ন উৎসবে কৃষাণিদের ধান কাটার প্রতিযোগিতা। রোববার বিকেলে চৈতন্যপুর গ্রামে
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামে নবান্ন উৎসবে কৃষাণিদের ধান কাটার প্রতিযোগিতা। রোববার বিকেলে চৈতন্যপুর গ্রামে

মুগ্ধ করল নবান্ন উৎসবে ধান কাটার প্রতিযোগিতা

জাতীয় সংগীত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো ধান কাটার প্রতিযোগিতা। ফর্সাপাড়া গ্রামের দল, কান্তপাশা গ্রামের দল ও চৈতন্যপুর গ্রামের দল কে কাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যায়, তা দেখতে ধানখেতের পাশে ভিড় ছিল শত শত মানুষের। পছন্দের দলকে উৎসাহ দিতে দিচ্ছল করতালি। এভাবেই রোববার বিকেলে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম নবান্ন উৎসবের।

উৎসবের আয়োজক মনিরুজ্জামান গোদাগাড়ী উপজেলায় নতুন নতুন ফসলের প্রবর্তন করে যাচ্ছেন। তিনি কৃষকদের বিনোদনের জন্য সাত বছর ধরে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যাচ্ছেন। প্রতিবছর এই অনুষ্ঠান থেকে দুজন কৃষককে কৃষিতে বিশেষ অবদানের জন্য সম্মাননা প্রদান করা হয়। এবারের অনুষ্ঠানে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে বগুড়ার কিষানি সুরাইয়া ফারহানা ও রাজশাহীর পবা উপজেলার কিষানি বিলকিস বেগমকে।

নবান্ন উৎসবের আয়োজন নিয়ে মনিরুজ্জামানের ভাষ্য, কৃষকদের জীবন মানে প্রতিদিনের লড়াই। আজ খরা তো কাল বর্ষা। একবার ফসল খরায় পুড়ে যায়, একবার অতি বৃষ্টিতে ভেসে যায়। আবার ঘরে তুলতে পারলেও কোনোবার দাম পড়ে যায়। কৃষকের মনে কখনোই স্থায়ী শান্তি বা সুখ আসে না। তাই তিনি এক দিনের জন্য হলেও কৃষকদের আনন্দ দেওয়ার জন্য এই বিনোদনের আয়োজন করে থাকেন। তিনি চান পরিকল্পিত কৃষিব্যবস্থা গড়ে উঠুক, তাহলে কৃষকদের এই দুঃখ দূর হবে, অনিশ্চয়তা দূর হবে। তাহলে কৃষকদের মনে প্রতিদিনই আনন্দ থাকবে।

অনুষ্ঠানে ধান কাটা প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। অতিথি ছিলেন রাজশাহী নিউ গভর্নমেন্ট ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক মেহেরুন্নেসা, রাজশাহী গোদাগাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম, আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার ফরিদা ইয়াসমিন ও গোদাগাড়ী ঈশ্বরীপুর ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা অতনু সরকার।

বাঙালির ঐতিহ্য নবান্ন অনুষ্ঠান কৃষকদের থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে উল্লেখ করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত অভিভূত হয়েছি চৈতন্যপুরীর মতো এমন একটি নিভৃত গ্রামে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কৃষকদের এক দিনের জন্য হলেও এমন একটি বিনোদনের আয়োজন তিনি (মনিরুজ্জামান) যাতে প্রতিবছর করতে পারেন, তাঁর পাশে আমরা রয়েছি।’

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামে নবান্ন উৎসবে কৃষাণিদের ধান কাটার প্রতিযোগিতা দেখতে মানুষ ভিড় জমায়

শিক্ষক মেহেরুন্নেসা বলেন, ‘শহরের বাইরে বের না হলে এ রকম নির্মল আনন্দের যে আয়োজন হতে পারে, আনন্দের যে কত ধরনের উৎস থাকতে পারে, তা আমরা বুঝতে পারতাম না। এই গ্রামে এসে কৃষকদের এই নবান্ন আয়োজন দেখে সত্যিই আমরা অভিভূত হয়েছি।’

ধান কাটা প্রতিযোগিতায় এবার অংশ নিয়েছিল চৈতন্যপুর কান্তপাশা ও ফর্সাপাড়া গ্রামের কিষানিরা। এর মধ্যে ফর্সাপাড়া গ্রামের প্রতিযোগী দল প্রথম হয়েছে। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন রিনা লাকড়া, তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিমলা ব্যাক ও স্বপ্ন লাকড়া। নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান কাটায় তাঁরা সময় নিয়েছেন ১০ মিনিট ১৪ সেকেন্ড। দ্বিতীয় হয়েছে কান্তাপাশা গ্রামের দল। এ দলে ছিলেন রোজিনা টপ্পো, সোনালী টপ্পো ও রতিকা মিনজ। তাঁরা সময় নিয়েছেন ১০ মিনিট ১৭ সেকেন্ড। তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন চৈতন্যপুর গ্রামের ববিতার দল। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পুতুল রানী ও রানী সরকার।

প্রথম স্থান অধিকারকারী দলের নেত্রী রিনা লাকড়া বললেন, এই নিয়ে পাঁচবার ধান কাটা প্রতিযোগিতায় তাঁর দল প্রথম স্থান অধিকার করেছে। এতে তাঁরা ভীষণ খুশি হয়েছেন। কীভাবে পঞ্চবারের মতো প্রথম স্থান অধিকার করলেন, জানতে চাইলে রিনা লাকড়ার জবাব, কাজ করতে করতে হাত চালু হয়ে গেছে। কেমন লাগছে জানতে চাইলে ওরাও ভাষায় তিনি বলেন, ‘হাম্মি খুব খুশি হইহো।’

ধান কাটার প্রতিযোগিতা শেষে গ্রামে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এখানে পুতুল রানীর দল ‘কাটি ধান আইরৈ’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন। একের পর এক আয়োজনে চলতে থাকে অনুষ্ঠান।