বাম থেকে জাকির হোসেন লিমন, রথিন পাল, ইয়াসির আরাফাত, ভগবান রুদ্র, অনিন্দ্য পাল জিৎ
বাম থেকে জাকির হোসেন লিমন, রথিন পাল, ইয়াসির আরাফাত,  ভগবান রুদ্র,  অনিন্দ্য পাল জিৎ

কক্সবাজারের পেনোয়ার গান কেন আপনাকে শুনতে হবে

ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে একটা গানের ভিডিওতে চোখ আটকে যায়। ক্লিক করে শুনতে শুরু করি। গানের নাম, ‘এ রুহের তলে’। সুরের মধ্যে কেমন একটা প্রশান্ত ভাব। গানের দৃশ্যায়নও ভিন্ন। গর্জনের বন, লতাগুল্ম আর সাগরের দৃশ্য যেন গানের কথা ও সুরকে আরও গভীর করে তোলে। এরপর গানটি শেষ হলে আরও একবার বাজাই। সেটি শেষ হলে আরও একবার। এভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক এই গানের আবেশেই কেটে গেল।

গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। কক্সবাজারের ব্যান্ড দল পেনোয়ার ‘এ রুহের তলে’ রিলিজ হওয়ার পরপরই শুনেছিলাম। এরপর আজ অবধি শুনেছি ১৩টি গান। শুনে মনে হয়েছে, কক্সবাজারের একটা ব্যান্ড এমন সুর, কথা আর গভীরতায় প্রচলিত গানের ধারা ভেঙে বেরিয়ে এল কী করে। অবাক হয়ে শুনেছি ‘কুহু ডাকের হন’ গানটি। গানটির শুরু এমন, ‘আধা রাইত্তা জোনাক ফরর কুহু ডাকের হন/ হইলজা ধরি টান মারের অচিন দরদ বন’। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় এমন গভীর গীতিকাব্য আগে তো শুনিনি। হালকা গিটারের টুংটাং, তবলা-মাদলের মূর্ছনার বাইরে কোনো উচ্চকিত বাদ্যযন্ত্রের আড়ম্বর নেই। গানের ভেতরে কেমন গমগমে নীরবতা জড়িয়ে আছে। যেন শ্রোতার ‘কলজে’ ধরে টান মারে আক্ষরিক অর্থেই।

‘রিক্ত গোলাপ’, ‘শুনতে যা চাও’, ‘প্রিয় মুখ’ কোন গানের কথা রেখে কোন গানের কথা বলি। পেনোয়ার ধীরলয়ের গড়িয়ে যাওয়া সুর ‘বিটলস’ আর ‘মহিনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডের কথা মনে পড়িয়ে দেবে আপনাকে। কবিতা তাদের গানে সুরের হাত ধরেছে। কেবল তা–ই নয়, কক্সবাজারের লোকজ সুর, পাহাড় আর সাগরে ঘেরা প্রকৃতির উদারতা সবই ধারণ করছে। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ধারায় পেনোয়া অবশ্যই নতুন এক সংযোজন।

কক্সবাজারের নাগরিকতার একটা ছবি যেন উঠে আসে ‘রাতের সাঁতার’ গানে। গানের দৃশ্যচিত্রে একটা ঘোড়া যেন শ্রোতাদের নিয়ে যায় অন্য এক ভ্রমণে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘গুজবাম্প’ বাংলায় তার নাম রোমহর্ষের কাছাকাছি কিছু। তবে বিষয়টি হলো গায়ের রোম খাঁড়া হয়ে যাওয়া। এই গানের কয়েকটি লাইন আমাকে এমন অভিজ্ঞতাই এনে দিয়েছিল। মনে হয়েছে এ তো পুরোই কবিতা। কেন বলছি সে কথা, তা বোঝাতে গানের লাইন কটি তুলে দিচ্ছি। ‘মুখে চাঁদের শিরনি লেগে থাকে মানুষের/ আসে আরও আরও চাঁদ পেয়ালা ভরে।/ আর অন্তরে যেন দুলছে কার মাজার!/ কারা করে কোলাহল বোবাদের জিকিরে।’

‘রিক্ত গোলাপ’, ‘শুনতে যা চাও’, ‘প্রিয় মুখ’ কোন গানের কথা রেখে কোন গানের কথা বলি। পেনোয়ার ধীরলয়ের গড়িয়ে যাওয়া সুর ‘বিটলস’ আর ‘মহিনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডের কথা মনে পড়িয়ে দেবে আপনাকে। কবিতা তাদের গানে সুরের হাত ধরেছে। কেবল তা–ই নয়, কক্সবাজারের লোকজ সুর, পাহাড় আর সাগরে ঘেরা প্রকৃতির উদারতা সবই ধারণ করছে। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ধারায় পেনোয়া অবশ্যই নতুন এক সংযোজন।

অনুশীলনের ফাঁকে পেনোয়ার সদস্যরা

পেনোয়া ব্যান্ডের গীতিকার, ভোকালিস্ট ইয়াসির আরাফাত কবিতা ও গল্প লেখেন। ২০১৪ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘রোদকথা’ প্রকাশিত হয়। গল্পকার থেকে গীতিকার হয়ে ওঠার গল্পটা তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক। তিনি বলেন, ‘গান তো গল্পই। অনেকগুলো স্তরে গল্পগুলোকে সুতায় বুনলে যে চাদর তৈরি হয়, সেটাই তো গান।’ তাঁর এই কথায় চমক লাগে। মনে হয় একে দিয়ে হবে। গান হবে।

পেনোয়া ব্যান্ডের আরেক সদস্য ভগবান রুদ্র। গানের অদ্ভুত সুন্দর সব সুর তাঁরই করা। তিনি নিজেও ভোকালিস্ট। পেনোয়ার গান যদি একটা পাখি হয়, তবে রুদ্র তাকে ওড়ার ডানা দিয়েছেন। বাংলা গানে এমন ‘সাবলাইম’ অর্থাৎ প্রশান্ত সুর খুব কমই শুনেছে শ্রোতারা। ব্যান্ডের আরেক সদস্য জাকির হোসেন লিমন ভোকালিস্ট হিসেবে আছেন। তিনি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গবেষণা করেন। পেনোয়ার গানে তিনিও নতুন মাত্রা যোগ করেছেন বলতে হয়। পেনোয়ার প্রথম অ্যালবামের মিউজিক প্রোডিউসার ছিলেন ফারমিন ফয়সাল। বর্তমানে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন অনিন্দ্য পাল জিৎ। এ ছাড়া লিড গিটারে সৌরভ দত্ত, বেজ গিটারে আহমেদ রাসেল ও নয়ন দাশ, কিবোর্ডে আছেন মির শিবলু।

চট্টগ্রামে পেনোয়ার কনসার্টের পোস্টার

পেনোয়ার অসাধারণ সব দৃশ্যকাব্যের রচয়িতা হলেন পংকজ চৌধুরী রনি। এ সময়কার একজন মেধাবী চলচ্চিত্র নির্মাতা। এ ছাড়া ভিজ্যুয়াল টিমে আরও আছেন নির্মাতা রাফায়েত নেওয়াজ, এনামুল হুদা ও কবি নৈরিৎ ইমু।

২০২৪ এর ১৩ ফেব্রুয়ারি এ রুহের তলে অ্যালবাম দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে পেনোয়া। ‘এ রুহের তলে’, ‘রাতের সাঁতার’, ‘কুহু ডাকের হন্’, ‘শুনতে যা চাও’ ও ‘ধ্যান নদী’ গানগুলো মুক্তির পর আলোচিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ১৩টি গানই স্পটিফাইসহ সব মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে।

আজ বৃহস্পতিবার রাত আটটায় চট্টগ্রামের থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে নতুন গান নিয়ে আসবে পেনোয়া। এটি চট্টগ্রামে এই ব্যান্ড দলের প্রথম কনসার্ট। জানতে চাইলে পেনোয়ার দলনেতা ইয়াসির আরাফাত বলেন, ‘চট্টগ্রামকে আমরা ডাকতাম শহর। এই শহর আমাদের বেশুমার স্মৃতির। আমাদের জীবনের প্রথম এই নগর জড়িয়ে গেছে এখন অস্তিত্বে, মননে। চট্টগ্রাম পেনোয়াকে ডাকছে বেশ অনেক দিন হলো। আর আমরাও তাকে গান শোনাব বলে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম সবকিছু। অবশেষে আমাদের বহু পুরোনো শহরে নতুন করে বসবে পেনোয়ার প্রথম গানের মজমা।’