
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় বহু আগে থেকে টিলাভূমিতে স্থানীয় খাসি ও নাগপুরি জাতের কমলার চাষ হয়ে আসছে। অনুকূল আবহাওয়া, কুয়াশা আর বেলে-দোআঁশ মাটির কারণে এ অঞ্চলের কমলা একসময় সারা দেশে সুনাম কুড়িয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ফলন কমে যাওয়া, মড়ক, বেড়ে যাওয়া উৎপাদন ব্যয় ও বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় অনেক চাষি কমলা চাষ থেকে সরে যান। অনেকে বাগান বিক্রি করে দেন, কেউ কেউ ফেলে রাখেন অবহেলায়।
এ সময় এক যুবক ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজেদের বাগান বাঁচানো এবং কমলার সুদিন আনার চেষ্টা শুরু করেন। সমস্যার উৎস খুঁজে সমাধানের পথ বের করেন, তিন বছর ধরে পাচ্ছেন সফলতা।
ওই যুবকের নাম তোফায়েল আহমদ (৩০)। উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনের রুপাছড়া এলাকার বাসিন্দা তিনি। এইচএসসি পাসের পর আর পড়াশোনা হয়নি। বংশপরম্পরায় তাঁদের পরিবার কমলা চাষ করে। বর্তমানে তাঁদের বাগানে ২ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ৫০-৬০টি কমলাগাছ আছে।
সম্প্রতি রুপাছড়া এলাকায় বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তোফায়েলের সঙ্গে। নিজের চেষ্টায় কীভাবে বাগান ঘুরে দাঁড়িয়েছে—সে গল্প শোনালেন তিনি।
ফলন কমেছিল, লেগেছিল মড়ক
তোফায়েলের দাদা মোবারক আলী প্রায় ৫০ বছর আগে লাঠিটিলা বনে কমলার বাগান শুরু করেন। তিনি ছিলেন বন বিভাগের হেডম্যান। পরে তাঁর বাবা ফখর উদ্দিন তা দেখাশোনা করতেন। তিন-চার বছর ধরে নিজেদের বাগানে ফলন কমে যায়। আশপাশের অনেক বাগানে মড়ক লেগে গাছ মরে যেতে শুরু করে। বাজারে ভালো দামও মিলছিল না। হতাশ হয়ে ২০২২ সালে কমলা চাষ ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন ফখর উদ্দিন। তখন এগিয়ে আসেন ছেলে তোফায়েল। বয়স ও অভিজ্ঞতা কম হলেও তিনি চ্যালেঞ্জ নেন। বাগানের সমস্যাগুলো বোঝার জন্য নিজস্ব অনুসন্ধান শুরু করেন।
তোফায়েল জানান, প্রথমে নিজেদের বাগান ঘুরে ঘুরে দেখলেন। কিছু গাছে পরগাছা, বিষডালের দেখা পেলেন। কমলাগাছের পুষ্টি এরা গিলছিল। ফলনের ভারে অনেক গাছের ডাল নিচের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। গুগল খুঁজে জানলেন, এতে গাছের নার্ভ সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, গাছ মরে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তখন আশপাশের পুরোনো চাষিদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এখনকার সময়ে শস্য, ফল কিংবা সবজি—সব ক্ষেত্রে ফলন বৃদ্ধিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ওপর নির্ভরতা বেশি। কিন্তু সব গাছ তা নিতে পারে না। খাসি ও নাগপুরি কমলাও এ রকম। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে দু-এক বছর ভালো ফলন হলেও পরে গাছ মরে যায়। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত ব্যবস্থার অভাবে বাজারে ভালো দাম মিলছিল না।
সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ
বাগান বাঁচাতে তোফায়েল কয়েকটি ধাপে উদ্যোগ নেন। তিনি বলেন, ‘কমলাগাছ থেকে পরগাছা, বিষডাল কাটা শুরু করি। আমাদের গবাদিপশুর গোবর আছে—রাসায়নিক সারের বদলে জৈব সার ব্যবহার শুরু করলাম। পোকামাকড়ের সংক্রমণ কিছু থাকলেও কোনো কীটনাশক ব্যবহার করিনি। বাঁশের খুঁটি পুঁতে ঝুঁকে পড়া ডাল সোজা রাখার ব্যবস্থা করি। তাতে ভালো ফলন পাই, মড়কের আশঙ্কাও কেটে যায়।’
বাজার সমস্যার সমাধানে তোফায়েল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্থানীয় কমলার প্রচারণা শুরু করেন। এতে ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ে। তোফায়েলের ভাষায়, এখানে অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত কমলার ভরা মৌসুম।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল আলম খান বলেন, সম্প্রতি তোফায়েলের বিষয়ে জেনে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। নিজের অনুসন্ধান, বুদ্ধিতে তোফায়েল কমলা চাষে সফল হয়েছেন। এখানে কমলার উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের সচেতন করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা। এ ক্ষেত্রে তোফায়েলের পরামর্শ কাজে লাগবে।
দেখছেন লাভের মুখ
আগে ফল বড় হওয়ার পর বাগান ২০-২৫ হাজার টাকায় পাইকারদের হাতে তুলে দেওয়া হতো। কিন্তু সার-কীটনাশক-পরিচর্যা বাবদ খরচ এর চেয়েও বেশি পড়ত। তাই তেমন লাভ ছিল না। তোফায়েল দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। বলেন, ‘তিন বছরে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার কমলা বিক্রি করেছি। অনলাইনে অনেক অর্ডার পাই। আমাদের বাগানের কমলার আকারও ভালো। তিন-চারটি কমলায় এক কেজি হয়ে যায়।’
তোফায়েলের মতে, কমলা চাষে সফল হতে জমি নির্বাচন জরুরি। দিনে ছয় ঘণ্টা রোদ পাওয়া যায়, এমন স্থান উপযোগী। নইলে রোদের তাপে ফল নষ্ট হয়। তিনি মনে করেন, চাষিদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো গেলে স্থানীয় জাতের কমলা আবারও দেশের বাজারে ফিরে আসবে। জৈব সার ব্যবহার, পরিচর্যার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। হতাশা দূর করতে হবে। তবেই কমলার সুদিন ফিরবে বলে মনে করেন তোফায়েল।