কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ভবেরমুড়া গ্রামের এই নলকূপ থেকে অনবরত পড়ছে পানি। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে। সোমবার দুপুরে ভবেরমুড়া পাক দরবার শরীফ প্রাঙ্গণে
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ভবেরমুড়া গ্রামের এই নলকূপ থেকে অনবরত পড়ছে পানি। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে। সোমবার দুপুরে ভবেরমুড়া পাক দরবার শরীফ প্রাঙ্গণে

কুমিল্লার বুড়িচং সীমান্ত

১৭ বছর ধরে নলকূপ থেকে গড়গড়িয়ে পড়ছে পানি, জন্মাচ্ছে কৌতূহল

ভবেরমুড়া। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই গ্রামটির অবস্থান বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত এলাকায়। এই গ্রামেরই একটি নলকূপকে ঘিরে মানুষের মধ্যে নানা ধরনের কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। নলকূপটিতে নেই কোনো হাতল বা বৈদ্যুতিক মোটরের সংযোগ। এরপরও দিনরাত নির্গত হচ্ছে সুপেয় পানি।

নলকূপটি যেখানে স্থাপন করা হয়েছে, সেটি ‘ভবেরমুড়া পাক দরবার শরীফ’ নামে একটি মাজার প্রাঙ্গণ। স্থানীয় ও মাজার কর্তৃপক্ষের দাবি, ওই নলকূপটি প্রায় ১৭ বছর আগে স্থাপন করা হয়েছিল। স্থাপনের দিন থেকেই টানা ১৭ বছর ধরে সেটি থেকে অনবরত পানি বের হচ্ছে। এই পানি এলাকার লোকজন পান করছেন, যাচ্ছে কৃষিজমিতেও। এরই মধ্যে স্থানীয়দের মধ্যে নলকূপ নিয়ে বিভিন্ন বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছে। তাঁরা বলছেন, বিশেষ কোনো ‘কুদরতে’ গড়গড়িয়ে এই পানি পড়ছে। এ ছাড়া এই পানি পান করলে ‘মনের আশা পূরণ’ হয় ভেবেও অনেকে সেটি পান করছেন।

কুমিল্লা নগর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ভবেরমুড়া গ্রামটির অবস্থান। সোমবার দুপুরে সরেজমিনে ওই নলকূপ থেকে গড়গড়িয়ে পানি পড়তে দেখা গেছে। নলকূপটি থেকে পানি তুলতে চাপ দেওয়ার জন্য কোনো হাতলও নেই। নিজ থেকেই সেটির মুখ দিয়ে পানি পড়ছে। বের হওয়া পানির চাপও অনেক। আধা লিটারের একটি মগ ভরতে সময় লেগেছে মাত্র দুই সেকেন্ড। সে হিসাবে প্রতি মিনিটে ১৫ লিটার, এক ঘণ্টায় ৯০০ লিটার এবং দিন ও রাত মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টায় বের হচ্ছে ২১ হাজার ৬০০ লিটার পানি।

মূল কারণটা হচ্ছে ভূগর্ভে পাহাড়ি এলাকায় পানির স্তর অনেক ওপরে চলে আসে। যার কারণে কোনো নলকূপ স্থাপন করলে ওই সব লেয়ারে সংযোগ পেলেই পানির অধিক চাপে এভাবে অনবরত পানি নির্গত হয়। যেটির পানির চাপও ভালোই থাকে।
মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ, নির্বাহী প্রকৌশলী, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, কুমিল্লা

স্থানীয় বাসিন্দা শিউলি বেগম নামে এক নারী বলেন, ‘গ্রামে ও মাজারের পাশে বর্তমানে অনেক টিউবওয়েল আছে। কিন্তু কোথাও থেকে এভাবে পানি পড়ে না। অন্য টিউবওয়েলে এক কলস পানি ভরতে অনেক সময় লাগে। আর এখানে এক মিনিটও লাগে না। এই পানি অনেক পরিষ্কার। আমরা এটি দিয়ে রান্না করি, নিজেরাও পান করি।’

সরেজমিনে দেখা দেখা যায়, গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষজন ওই নলকূপের পানি পান করছেন। কেউ হাত-মুখ ধুচ্ছেন, আবার কেউ গোসল করছেন। দূর থেকে আসা মানুষজন এই পানি কেউ জগ বা বোতলে ভরে নিয়ে যাচ্ছেন। নলকূপ থেকে অনবরত বের হওয়া এই পানি পাইপ ও নালার মাধ্যমে চলে যাচ্ছে আশপাশের কৃষিজমিতে।

‘ভবেরমুড়া পাক দরবার শরীফ’ নামে ওই মাজারের বর্তমান পীর মাওলানা কাজী রফিকুল ইসলাম হক শাহ্। প্রথম আলোকে তিনি জানান, প্রায় ১৭ বছর আগে এই টিউবওয়েল তিনি নিজ উদ্যোগ নিয়ে স্থাপন করেন। এটির গভীরতা প্রায় ৬০০ ফুট। এই দরবার শরীফের (মাজার) বয়স প্রায় ১০০ বছর। এখানে তাঁর দাদা ও বাবাও এই মাজারের পীর ছিলেন। প্রতিবছর এতে বাংলাদেশ ও ভারতের অসংখ্য ভক্তের আগমন ঘটে। বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে এই দরবারের লক্ষাধিক ভক্ত রয়েছেন। মাজারে একসময় সুপেয় পানির অভাব ছিল। আশপাশেও পানির তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ভক্তরা পুকুর থেকে পানি পান করতেন। সবার জন্য বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করতে এই নলকূপ বসানো হয়।

নলকূপটি থেকে নির্গত সুপেয় পানি সাধারণ মানুষ পান করার পাশাপাশি নানা কাজে ব্যবহার করান। অনেকে নিয়েও যান

রফিকুল ইসলাম বলেন, দরবার প্রাঙ্গণে যেদিন নলকূপ বসানো হয়েছিল, সেদিন থেকেই হাতল ছাড়া এভাবে পানি বের হতে শুরু করে। নলকূপের ওপরের অংশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ভেতরে যেন কেউ ময়লা না ফেলে। মানুষ মনে করে এটি এই মাজারে থাকা পীর আউলিয়াদের বিশেষ কুদরত। এই পানি আর্সেনিকমুক্ত, গ্যাসেরও কোনো গন্ধ নেই। গরমকালে শীতল ঠান্ডা পানি আর শীতে হালকা গরম পানি বের হয়। চৈত্র মাসে পানিপ্রবাহ কিছুটা কম থাকে।

গ্রামের বাসিন্দা সেলিম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ও মাইনসে বিশ্বাস করে এইডা অলিরার (পীর) কেরামতি। এই পানি মাইনসে খায় আবার লইয়াও যায়। এহন ঠান্ডা পানি গড়গড়াইয়া পড়তাছে, শীতকালে গরম পানি পড়ে। তহন মনে হয় নিচে কেউ হিটার লাগাইছে। শুরুর দিন থাইক্কা এই অবস্থা দেখতাছি।’

এই পানি মাইনসে খায় আবার লইয়াও যায়। এহন ঠান্ডা পানি গড়গড়াইয়া পড়তাছে, শীতকালে গরম পানি পড়ে। তহন মনে হয় নিচে কেউ হিটার লাগাইছে। শুরুর দিন থাইক্কা এই অবস্থা দেখতাছি।
সেলিম খান, স্থানীয় বাসিন্দা

ভবেরমুড়া গ্রামের বিপরীতে ভারতের নজিরপুরা গ্রামের অবস্থান। ওই গ্রামের যুবক মো. শরীফ মিয়াকে পাওয়া গেছে ঘটনাস্থলে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি প্রায়ই এখানে আসি। এটি আল্লাহর বিশেষ রহমত। অলি-আউলিয়ার দরবারে এসে এই পানি যে যেই নিয়ত করে খায়, আল্লাহর রহমতে তাঁর মনের আশা পূরণ হয়। এই টিউবওয়েলের পানি অজু, গোসল, রান্নাবান্না ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়। এখন কাঁটাতারের বেড়া হওয়ায় ভারতের মানুষ কম আসে, আগে অনেক মানুষ এখানে আসত। আমাদের এলাকার অনেক মানুষ এই দরবারের ভক্ত।’

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ বলেন, বিষয়টি অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমন ঘটনা পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ঘটে। বিশেষ করে কক্সবাজার ও বান্দরবানের অনেক পাহাড়ি এলাকায় এমন অনেক নলকূপ আছে, যেগুলোতে এভাবে পানি বের হচ্ছে। এর মূল কারণটা হচ্ছে ভূগর্ভে পাহাড়ি এলাকায় পানির স্তর অনেক ওপরে চলে আসে। যার কারণে কোনো নলকূপ স্থাপন করলে ওই সব লেয়ারে সংযোগ পেলেই পানির অধিক চাপে এভাবে অনবরত পানি নির্গত হয়। যেটির পানির চাপও ভালোই থাকে।

স্থাপনের পর থেকেই নলকূপটি থেকে অনবরত পানি বের হওয়া এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি

নাসরুল্লাহ বলেন, চৈত্র মাস বা শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভে যখন পানির স্তর নিচে নেমে যায়, তখন হয়তো পানি বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায়, না হলে অনেক অনেক কমে যায়। বর্তমানে বা বর্ষাকালে ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার বেশি ওপরে থাকায় পানিও বেশি পরিমাণে নির্গত হয়। এ বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগকে সরেজমিনে গিয়ে বিষয়টির বিস্তারিত খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।

ময়মনসিংহ থেকে কৃষিকাজ করতে ভবেরমুড়া গ্রামে এসেছেন সত্তরোর্ধ্ব সাত্তার মিয়া। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘১৫ বছর আগে এই এলাকায় কৃষিকাজ করতে এসে এই টিউবওয়েলটি দেখেছিলাম, এবার এসেও আগের মতোই পানি পড়তে দেখলাম। পানির স্বাদও আগের মতোই মনে হয়েছে। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন এখানে আসেন।’

জানতে চাইলে বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তানভীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সম্প্রতি বিষয়টি জেনেছি। এরই মধ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগকে বলা হয়েছে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন কথা ছড়াচ্ছে, সৃষ্টি হয়েছে কৌতূহলের, যার কারণে আমরা চেষ্টা করব যদি সম্ভব হয় নলকূপটি বন্ধ করে দিয়ে আশপাশে আরেকটি নলকূপ স্থাপন করার জন্য।’