
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বহিষ্কারের পরপরই জাহাঙ্গীর আলমকে ঘিরে কমতে থাকে কর্মী, সমর্থক আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের আনাগোনা। সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্তের পর একরকম নীরব বনে যান তিনি। সব সময় মানুষজনে গমগম করা তাঁর বাড়িটিও ফাঁকা হয়ে যায়।
মেয়র পদ থেকে বরখাস্তের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে সম্প্রতি উচ্চ আদালতে রিটের পর বদলাতে শুরু করেছে দৃশ্যপট। নীরব অবস্থান থেকে সরব হতে শুরু করেছেন নানা কারণে আলোচিত–সমালোচিত জাহাঙ্গীর আলম। সঙ্গে বেড়েছে কর্মী–সমর্থকদের আনাগোনা। সব মিলিয়ে আবারও আলোচনায় জাহাঙ্গীর আলম। এরই মধ্যে চাঙাভাব দেখা দিয়েছে তাঁর কর্মী-সমর্থকদের মাঝেও।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে গোপনে ধারণ করা জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কথোপকথনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। এরই মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে গত বছরের ১৯ নভেম্বর দল থেকে বহিষ্কার হন জাহাঙ্গীর আলম। বিতর্কিত মন্তব্যে ‘ক্ষুব্ধ’ ব্যক্তিরা তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি জেলায় আদালতে মামলাও করেন। সরকারি সম্পদের অপব্যবহার, অর্থ আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগে ২৫ নভেম্বর মেয়র পদ থেকে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর প্রায় ৯ মাস পর গত ১৪ আগস্ট পুনরায় মেয়র পদ ফিরে পেতে উচ্চ আদালতে রিট করেন তিনি।
রিটের বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কতগুলো মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে প্রায় এক বছর ধরে আমাকে সাময়িক বরখাস্ত করে রাখা হয়েছে। আমি জনগণের সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত মেয়র। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নপূরণে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চাই। তাই বাধ্য হয়েই উচ্চ আদালতে রিট করেছি।’
রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৩ আগস্ট বিচারপতি জাফর আহমেদ ও বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল দেন। হাইকোর্ট জানতে চান, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ থেকে মো. জাহাঙ্গীর আলমকে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়সচিব; আইনসচিব; গাজীপুরের জেলা প্রশাসকসহ বিবাদীদের দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
জাহাঙ্গীর আলমের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যসংবলিত ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই কিছুটা উপেক্ষিত হয়ে পড়েন জাহাঙ্গীর আলম। তখন থেকেই তাঁকে জেলার কোনো সভা, সমাবেশ বা অনুষ্ঠানে ডাকা হয়নি। তিনি নিজেও কোনো অনুষ্ঠান বা কর্মসূচির আয়োজন করেননি। এর মধ্যে দলীয় ও মেয়র পদ হারানোয় একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েন তিনি। এখন তাঁকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
রিট করে জাহাঙ্গীর আলম কী আবারও মেয়র পদে ফিরতে পারবেন— এমন আলোচনা এখন নগরের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রাজনীতির মাঠে।
উচ্চ আদালতে রিট করার পরদিন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ছয়দানার নিজ বাসভবনে বড় আকারে কর্মসূচির আয়োজন করেন জাহাঙ্গীর আলম। সেখানে সকাল থেকেই দলে দলে উপস্থিত হন কর্মী-সমর্থকেরা। এর পর থেকে প্রতিদিনই জাহাঙ্গীরকে ঘিরে ভিড় করছেন কর্মী-সমর্থকেরা। গত ২৩, ২৭ ও ২৯ আগস্ট দুপুরের দিকে জাহাঙ্গীর আলমের বাসভবনে গিয়ে নিচতলা ও দোতলা মিলিয়ে ৩০-৪০ জনের জটলা দেখা গেছে। ভবনের নিরাপত্তাকর্মী নাজমুল জানান, রিটের খবর ছড়াতেই নতুন করে বেড়েছে মানুষের সংখ্যা। প্রতিদিনই নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে।
জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো তদন্ত করতে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কমিটির প্রধান করা হয় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নগর ও উন্নয়ন অনুবিভাগ) মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকীকে। এ বছর ১০ জানুয়ারি থেকে ১১টি অভিযোগের ওপর কাজ শুরু করে কমিটি। এরপর আট মাস পার হলেও এখনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েনি। জাহাঙ্গীর আলম আদালতে রিট করার পর গত ২০ আগস্ট নগর ভবনে আসেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তাঁরা বিভিন্ন নথিপত্র যাচাই, তথ্য সংগ্রহ, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদসহ বিভিন্ন নথিপত্রের অনুলিপি সংগ্রহ করেন।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে অতিরিক্ত সচিব মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের তদন্তকাজ চলছে। শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। অনেকগুলো অভিযোগ নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। অনেক মানুষের কথা শুনতে হচ্ছে। তাই আমাদের একটু সময় লাগছে।’