নীলফামারীতে সার পরিবেশকের দোকানের সামনে কৃষকদের ভিড়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপরে সদর উপজেলার রামগঞ্জ বাজারে
নীলফামারীতে সার পরিবেশকের দোকানের সামনে কৃষকদের ভিড়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপরে সদর উপজেলার রামগঞ্জ বাজারে

চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম, নীলফামারীতে সারসংকটে বিপাকে কৃষক

নীলফামারীতে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় সারসংকটে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। অনেকে সরকারি মূল্যে সার না পেয়ে দ্বিগুণের বেশি মূল্যে খোলাবাজার থেকে সার সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

জেলা সদরের টুপামারী ইউনিয়নের রামগঞ্জ বাজারে গতকাল বিসিআইসি সার পরিবেশক মেসার্স ময়েজ উদ্দিনের দোকানে দেখা যায় সার নিতে আসা কৃষকদের সারি। ওই ইউনিয়নের সিতারপাঠ গ্রামের কৃষক লুৎফর রহমান বলেন, ‘হামাক মারি ফেলাছে বাপোরে। দুই দিন থাকি ঘুরায়ছে, হামাক লাগে ৩ বস্তা টিএসপি সার, হামাক দেয়ছে হাফ বস্তা (২৫ কেজি)।’

একই ইউনিয়নের কিছামত দোগাছি গ্রামের রবিনাথ রয় (৫৫) বলেন, ‘তিন বিঘা জমিত ভুট্টা, দুই বিঘা জমিত আলু আবাদ করব। তিন দিন থাকি ঘুরছি টিএসপি, এমওপি, ড্যাব নেওয়ার জন্য। একটাও পাইছি না। বাইরত দাম বেশি, তারপরও পাওয়া যায়ছে না।’

দুহুলীপাড়া গ্রামের কৃষক আবদুল ওহাব বলেন, ‘আমি এবার ছয় বিঘা জমিতে আলু লাগাব, দুই বিঘায় ভুট্টা। এ জন্য আমার ৭ বস্তা টিএসপি ও ৪ বস্তা এমওপি সার দরকার। কিন্তু এমওপি একদম নেই। টিএসপি ২৫ কেজি দেওয়ার কথা। তা-ও পাব কি না, জানি না।’

টুপামারী ইউনিয়নের কান্দুরার মোড় এলাকায় মেসার্স প্রামাণিক ট্রেডার্সের প্রতিনিধি সাইফ আল হাসান বলেন, ‘আমাদের ডিলারশিপ নেই। আমরা বাইরে থেকে বেশি দামে সার সংগ্রহ করে খোলাবাজারে বিক্রি করি। কিন্তু বাজারে সার না থাকায় দাম বেশি।’ তাঁরা প্রতি বস্তা টিএসপি ২ হাজার ৯০০ টাকা, এমওপি ২ হাজার ২০০ ও ইউরিয়া ১ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি করছেন।

একই সময়ে জেলার জলঢাকা, ডোমার, ডিমলা, কিশোরগঞ্জ উপজেলায়ও সারসংকটের খবর পাওয়া গেছে। জলঢাকা উপজেলার শিমুলবাড়ি ইউনিয়নের বালাপুকুর গ্রামের কৃষক একাব্বর আলী (৫৫) বলেন, ‘আমি তিন দিন ধরে ধরনা দিয়েও এক বস্তা সার জোগাড় করতে পারিনি। আজ-কাল করে সময় দেয়; কিন্তু সার পাওয়া যায় না।’

এদিকে ডোমার উপজেলার গোমনাতি ইউনিয়নের আমবাড়ি বাজারে বিসিআইসি সার পরিবেশক রেহানা পারভীনের আরবি এন্টারপ্রাইজে গতকাল সার না পেয়ে দোকান ভাঙচুর করেছে ৫০০ থেকে ৭০০ ব্যক্তি। বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) নীলফামারী জেলার সাধারণ সম্পাদক তাপস কুমার সাহা বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

সারসংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বিএফএর নীলফামারী জেলা সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ সরকার বলেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় কৃষকদের চাহিদামতো সার দেওয়া যাচ্ছে না। তবে এই মুহূর্তে ইউরিয়া সারের কোনো ঘাটতি নেই। টিএসপি ও এমওপি সারের চাহিদা বেশি বলে জানান তিনি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নীলফামারীর ছয় উপজেলায় বিএডিসির ১৩০ জন ও বিসিআইসির ৭৪ জন সার পরিবেশক আছেন। গত নভেম্বরে ৮ হাজার ৬২ মেট্রিক টন ইউরিয়া সারের চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৩ হাজার ৭৬৭ মেট্রিক টন। ১ হাজার ৯৭৬ মেট্রিক টন টিএসপির চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ মিলেছে ১ হাজার ৮৩ মেট্রিক টন। অন্যদিকে ৪ হাজার ৭৬৫ মেট্রিক টন এমওপি সারের বিপরীতে বরাদ্দ মিলেছে ২ হাজার ৮৭৯ মেট্রিক টন। পাঁচ হাজার ৬৭০ মেট্রিক টন ড্যাব সারের চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ মিলেছে ৪ হাজার ২৩ মেট্রিক টন।

একইভাবে চলতি ডিসেম্বর মাসে ৯ হাজার ৩০৫ মেট্রিক টন ইউরিয়া সারের চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ হয়েছে ৬ হাজার ৭৪০ মেট্রিক টন। ১ হাজার ৯৪৬ মেট্রিক টন টিএসপি চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ হয়েছে ৮৬৭ মেট্রিক টন। ৫ হাজার ২১০ মেট্রিক টন এমওপি সারের চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ মিলেছে ২ হাজার ২৬৫ মেট্রিক টন। ৬ হাজার ১১০ মেট্রিক টন ড্যাবের চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ মিলেছে ৫ হাজার ১২৫ মেট্রিক টন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মনজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সারের কোনো সংকট নেই। কৃষকদের প্রয়োজন অনুযায়ী তাঁরা সার সরবরাহ করছেন। অনেক সময় কৃষকেরা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সার সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। এতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। ইতিমধ্যে তাঁরা ডিসেম্বর মাসের বরাদ্দ দিয়েছেন। পরিবেশকদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে সার উত্তোলন করে কৃষকদের কাছে বিক্রির তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। ডিসেম্বর মাসের সার উত্তোলন করলে সারের কোনো সংকট থাকবে না।