লেকের পাড়ে বসে এক মনে বাঁশি বাজান কৃষ্ণ দাস। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাধবপুর লেক এলাকায়
লেকের পাড়ে বসে এক মনে বাঁশি বাজান কৃষ্ণ দাস। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাধবপুর লেক এলাকায়

মোহনীয় সৌন্দর্যের মাধবপুর লেকের নিস্তব্ধতা ভাঙে কৃষ্ণ দাসের বাঁশির সুরে

লেকের স্বচ্ছ জলে লুটোপুটিতে মেতেছে নীল শাপলা। চা–বাগানের টিলার ঢেউখেলানো প্রকৃতির কোলে গড়ে উঠেছে লেকটি। এটির ওপর সকালবেলায় ভেসে থাকে হালকা কুয়াশার আবরণ, দুপুরে জলের গভীরে উঁকি দেয় ঝলমলে আকাশের প্রতিচ্ছবি, আর সন্ধ্যার নরম আলো দ্রুত হারাতে থাকে অদূর পাহাড়ের গা ছুঁয়ে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরে এই লেকের প্রতিটি ভোর, দুপুর আর বিকেল যেন ভিন্ন ভিন্ন সব দৃশ্যপটের জন্ম দেয়।

লেকের এমন মোহনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে আরেকটি জিনিস আকর্ষণ করে পর্যটকদের, সেটি হলো কৃষ্ণ দাসের বাঁশির সুর। লেকের চারপাশে প্রায়ই স্তব্ধতা ঘিরে ধরে, নিয়ম মেনে সেই নীরবতা ভাঙেন তিনি। কখনো বসে, দাঁড়িয়ে এবং চোখ বন্ধ করে আপন মনে সুর তোলেন। তাঁর বাঁশির সুর লেক ছাপিয়ে বাতাসে ভেসে ভেসে যায় দূর পাহাড়ের গায়ে। কখনো প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। প্রকৃতির এমন নিবিড় নীরবতা, লেকের শীতল হাওয়ার মাদকতা আর কৃষ্ণ দাসের মর্মস্পর্শী বাঁশির সুরে মিলেমিশে মাধবপুর লেক হয়ে ওঠে আরও উপভোগ্য।

প্রায় প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মাধবপুর লেকর পাড়ের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বাঁশি বাজান ৪৫ বছর বয়সী কৃষ্ণ দাস। পর্যটকেরা কেউ হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ান, মুগ্ধতা নিয়ে হারাতে চান কৃষ্ণ দাসের বাঁশির সুরেলা ভুবনে। কেউ কেউ পাশেই কয়েক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে শোনেন, কেউ আবার মুঠোফোনে বন্দী করেন অসাধারণ মুহূর্তটি। অনেকেই খুশি হয়ে কৃষ্ণের হাতে গুঁজে দেন কিছু টাকা, কেউ আবার শুনিয়ে যান মুগ্ধতার কথা। এই সামান্য আয় দিয়ে স্ত্রী আর এক মেয়েকে নিয়ে সংসার চালান।

গত শুক্রবার নিজের গল্প বলতে গিয়ে কৃষ্ণ দাসের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে নানা অভিজ্ঞতার রেখা। তাঁর ভাষায়, ‘ছোটবেলা থেকেই বাঁশির সুর আমাকে টানত। ভারত থেকে এই বাঁশি বাজানো শিখেছি। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে পড়াশোনা হয়নি। ছোটবেলা থেকেই কাজ করেছি। এখন এই বাঁশিই আমার জীবনের প্রধান ভরসা। লেকে যারা আসে, তারা সুর শুনে খুশি হয়। কেউ কেউ ১০, ২০ টাকা দেয়।’

অনেক পর্যটক কৃষ্ণ দাসের বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যান। কেউ কেউ মুঠোফোনে ভিডিও করেন। কেউ খুশি হয়ে তুলে দেন টাকা

এ পর্যায়ে আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘এ টাকাতেই চলে আমার সংসার। তবে এখন আগের মতো আয় হয় না, কিন্তু বাঁশি বাজানো ছেড়ে দিতে পারব না। এই সুর আমার জীবনের অংশ।’

এর আগে কৃষ্ণ দাসের বাঁশি বাজানোর দৃশ্য ধারণ করছিলেন রাজধানী থেকে আসা পর্যটক ফাহিমা আক্তার। তিনি বলেন, ‘লেকের নীরবতা আর সবুজ প্রকৃতিতে তাঁর (কৃষ্ণ) বাঁশির সুর যেন জাদু ছড়িয়ে দেয়। আমরা পুরো লেক ঘুরছিলাম, সঙ্গে তাঁর বাঁশির সুরও বাতাসে ভেসে আমাদের পাশে চলছিল। মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি কোনো গল্প বলছে। আর সেই গল্পের ভাষা হলো এই বাঁশির সুরেলা ধ্বনি।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন জানান, কৃষ্ণ বহু বছর ধরে মাধবপুর লেকের আশপাশে বাঁশি বাজান। অনেক পর্যটক তাঁর সুরে মুগ্ধ হয়ে আবারও ফিরে আসেন। কেউ কেউ শুধু তাঁর সুর শোনার জন্যই লেকপাড়ে বসে থাকেন। আশপাশের বিয়ে, আড্ডা কিংবা ছোটখাটো অনুষ্ঠানেও বাঁশি বাজিয়ে আনন্দ ছড়ান। সুরই তাঁর জীবন, আর এই সুর বিলিয়েই তিনি মানুষের মুখে হাসি ফোটান।

বাঁশির সুরকে ঐতিহ্যের অংশ উল্লেখ করে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাখন চন্দ্র সূত্রধর বলেন, ‘এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। বংশীবাদক কৃষ্ণ দাসের বিষয়ে আমরা অবগত। উপজেলা প্রশাসন থেকে সহায়তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখব।’