Thank you for trying Sticky AMP!!

‘দুইডা বেটির মরা শরীর দেখিনু, কিন্তু ওর বাপের মুখখান আর দেখা পানুনি’

নৌকাডুবিতে নিখোঁজ সরেন্দ্রনাথ বর্মণের বড় ছেলে স্বপন চন্দ্র বর্মণ ও স্ত্রী শান্তি রানী। গত শনিবার বিকেলে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার নগর সাকোয়া-ডাঙ্গাপাড়ায়

‘একটা বছর হয়া গেল বাপু, মানুষটা আর ফিরে আসিল নাই। নয়া (নতুন) লোক বাড়িত আসিলে মনডা কহচে, কী জানি খবর আসিল। নিজের হাতে দুইডা বেটির (মেয়ের) মরা শরীর নারেচারে দেখিনু, কিন্তু ওর বাপের মুখখান আর দেখা পানুনি (দেখতে পেলাম না)।’

কথাগুলো বলছিলেন পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার নগর সাকোয়া-ডাঙ্গাপাড়া এলাকার বাসিন্দা শান্তি রানী। করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ তাঁর স্বামী সরেন্দ্রনাথ বর্মণ (৬৩)। একই ঘটনায় দুই মেয়ে, এক জামাতা, বেয়াইসহ পাঁচ স্বজনকে হারান শান্তি রানী। ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো স্বামীর সন্ধান পাননি তিনি।

গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বাজারের পাশে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। যাত্রীদের অধিকাংশই ওই মন্দিরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর নৌকাটি ডুবে যায়। এতে ৭১ জনের লাশ উদ্ধার হয়। এখনো নিখোঁজ একজন।

Also Read: পঞ্চগড়ে নৌকাডুবির ঘটনার ১১ দিনেও নিখোঁজ ৩ জনের সন্ধান মেলেনি

গত শনিবার সাকোয়া ইউনিয়নের নগর সাকোয়া-ডাঙ্গাপাড়ায় সরেন্দ্রনাথ বর্মণের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় শান্তি রানীর সঙ্গে। কথা বলার সময় তাঁর চোখে পানি ছলছল করছিল। এ সময় পাশে দাঁড়িয়ে মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন সরেন্দ্রনাথের ছেলে স্বপন চন্দ্র বর্মণ (৩৮)। নৌকাডুবির এক বছরেও সরেন্দ্রনাথ বর্মণের জন্য অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না স্ত্রী-সন্তানদের। তাঁকে জীবিত অথবা মৃত খুঁজে পেতে এখনো মাঝেমধ্যে নদীর পাড়ে ঘোরেন তাঁরা।

পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীতে শতাধিক যাত্রী নিয়ে নৌকাডুবির পর ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার তৎপরতা

স্বপন চন্দ্র বর্মণ বলেন, ঘটনার দিন তাঁর বাবা ও ছোট ভাইয়ের শ্বশুর একসঙ্গে বাইসাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। নৌকায় বাবাসহ সাতজন আত্মীয়স্বজন ছিলেন। নৌকাডুবির ঘটনায় মারা যাওয়া দুই বোন, এক ভগ্নিপতি, ছোট ভাইয়ের শ্বশুরসহ পাঁচজনের লাশ পেয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে থাকা তাঁর বাবার খোঁজ আজও পাননি। তবে সনাতন ধর্মের বিধান অনুযায়ী ঘটনার ২৭ দিন পর তাঁর বাবার প্রতীকী দাহ (খড়ের তৈরি বিশেষ বস্তু দাহ) করেছেন। পরে শ্রাদ্ধও করেছেন।

স্বপন চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘এখনো মাঝেমধ্যে নদীর পাড়ে গিয়ে পাথর-বালু তোলা লোকজনকে বলে আসি বাবার কথা, আমার বাবার পরনে থাকা কাপড়চোপড়ের বর্ণনা দিয়ে আসি। কিন্তু কোথাও থেকে কোনো খবর পাই না। নৌকাডুবির ঘটনায় ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে নৌকার পেছন দিকে ধপধপে সাদা পাঞ্জাবি পরা যে লোকটা দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনিই আমার বাবা। বাবার লাশটা পেলে অন্তত নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম যে আমরা বাবার সৎকারটা করতে পেরেছি। কিন্তু এক বছর হয়ে গেলেও আমাদের অপেক্ষা আর শেষ হয় না।’

Also Read: করতোয়ায় নৌকাডুবির দেড় মাসের মাথায় নিখোঁজ এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন থেকে গত বছরের ৩ অক্টোবর ভোর পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা ১২টি দলে বিভক্ত হয়ে উদ্ধার অভিযান চালান। এতে ৭০ জন সদস্য কাজ করেন। করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাট থেকে দিনাজপুরের আত্রাই নদ পর্যন্ত প্রায় ৪২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ উদ্ধার অভিযান চলেছিল। নৌকাডুবির ঘটনার আট দিন পর গত ৩ অক্টোবর ভোরে রংপুর, কুড়িগ্রাম ও রাজশাহী থেকে আসা ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা উদ্ধার কার্যক্রম বন্ধ করে নিজ নিজ ইউনিটে ফিরে যান।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে আরও জানা যায়, ঘটনার দিন ৪৭ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থ (মাঝের অংশ) নৌকাটিতে মোট ১০৫ জন যাত্রী উঠেছিলেন। নৌকাডুবির পর সাঁতরে পাড়ে ওঠেন ৬ জন, জীবিত উদ্ধার হন ২৭ জন। ঘটনার চতুর্থ দিন পর্যন্ত নৌকাডুবির ঘটনায় ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। এরপর জেলা প্রশাসনের করা নিখোঁজের তালিকায় ছিলেন এক শিশুসহ তিনজন।

করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাটে মানুষের পারাপার। গত শনিবার দুপুরে

এরপর ঘটনার দেড় মাসের মাথায় নৌকাডুবির স্থান থেকে প্রায় ৫০ গজ দক্ষিণে নদীর বালুর নিচ থেকে ভূপেন্দ্রনাথ বর্মণ (৪২) নামের নিখোঁজ এক ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। এর দুই দিন পর নৌকাডুবির ঘটনার ৪৭ দিনের মাথায় কাছাকাছি স্থানে বালুর নিচ থেকে জয়া রানী (৪) নামের একটি শিশুর গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ নিয়ে নৌকাডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৭১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখন নিখোঁজের তালিকায় রয়েছেন শুধুই সরেন্দ্রনাথ বর্মণ।

Also Read: করতোয়ায় নৌকাডুবির ৪৭ দিন পর নিখোঁজ এক শিশুর লাশ উদ্ধার

শনিবার দুপুরে করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিতে টইটম্বুর করতোয়া নদী। নৌকায় পারাপার হচ্ছেন লোকজন। অতিরিক্ত যাত্রী পারাপার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন দুজন গ্রাম পুলিশ। নৌকায় তিনটি লাইফ জ্যাকেট রয়েছে। তবে মাঝি বা যাত্রীদের কেউ তা পরেননি।

ওই ঘটনার পর ঘাটের ইজারাদার বদলে গেছেন। তৈরি করা হয়েছে নতুন নৌকা। তবে ঘাটের কোনো উন্নয়ন হয়নি। আর নৌকাডুবির পর জনপ্রতিনিধিরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, চার মাসের মধ্যে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে। তবে এক বছর পরও সেখানে সেতু নির্মাণের কার্যক্রম দেখা যায়নি।

Also Read: করতোয়ার তীরে প্রিয়জনকে খুঁজে ফিরছেন স্বজনেরা