নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজব্বর ইউনিয়নের উত্তর চরজব্বর গ্রামের পরিষ্কার বাজার
নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজব্বর ইউনিয়নের উত্তর চরজব্বর গ্রামের পরিষ্কার বাজার

নোয়াখালীর পরিষ্কার বাজার আসলেই কি পরিষ্কার, কেন এমন নাম

নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরজব্বর ইউনিয়নের উত্তর চরজব্বর গ্রামের পরিষ্কার বাজারের নামের পেছনে আছে এক ব্যতিক্রমী গল্প। অর্ধ শতাব্দী আগে এলাকার এক সৎ ও পরিচ্ছন্ন মানুষ আক্তারুজ্জামান ওরফে ‘পরিষ্কার’-এর নামে বাজারটির নামকরণ হয়। তিনি শুধু ব্যবসায়ীই ছিলেন না, বরং স্থানীয় মানুষের উপকারে নিজের জমি দিয়ে বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন। এখনো তাঁর দেখানো পথেই চলছে পরিষ্কার বাজার।

চারপাশে সবুজে ঘেরা গ্রাম। গ্রামের চারদিক থেকে চারটি পাকা সড়ক এসে মিলেছে এক জায়গায়, একটি বাজারে। সেই বাজারটির নাম পরিষ্কার বাজার। নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজব্বর ইউনিয়নের উত্তর চরজব্বর গ্রামের এই বাজারের নাম শুনলেই যে কারওই মনে কৌতূহল জাগতে পারে, বাজারটি আসলেই কি পরিষ্কার? কেনই–বা বাজারের এমন নাম হলো?

এসব জানতে সম্প্রতি গিয়েছিলাম সুবর্ণচরের চরজব্বর এলাকায়। সেখানে পরিষ্কার বাজার ঘুরে রাস্তা-দোকানপাট বেশ পরিচ্ছন্নই দেখা গেছে। কিন্তু এমন নামকরণের পেছনে কেবল বাজারের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতাই নয়, আছে আরও এক কাহিনি। বাজারের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর মুখে শোনা সে গল্প বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। আজ থেকে অর্ধশতাব্দীর বেশি বছর আগের কথা। আক্তারুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি ছিলেন এই এলাকার বাসিন্দা। ব্যক্তিজীবনে লেনদেন থেকে সবকিছুতে স্বচ্ছতা বজায় রাখতেন। যাঁকে, যে কথা দিতেন, সেটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করতেন। গ্রামবাসীর কথায় ‘ওয়াদার বরখেলাপ’ তিনি কখনোই করতেন না। পোশাক–পরিচ্ছদেও তিনি সব সময় থাকতেন পরিচ্ছন্ন। এসব কারণে গ্রামের সবাই ‘পরিষ্কার’ নামে ডাকতেন।

সত্তরের দশকে আক্তারুজ্জামান তাঁর বাড়ির পাশের সড়কের মোড়ে একটি মুদিপণ্যের দোকান নিয়ে বসা শুরু করেন। তাঁর দোকান ঘিরেই গভীর রাত অবধি চলত আশপাশের এলাকার মানুষজনের আড্ডা। পরে সেখানে আরও কয়েকটি দোকান হয়। পরে দোকানগুলো ঘিরে সেখানে হাট মেলান আক্তারুজ্জামান ওরফে পরিষ্কার। প্রতি রোববার ও বৃহস্পতিবার হাট বসতো। গ্রামের লোকজন তাঁর নাম অনুসারে বাজারের নাম দেন পরিষ্কার বাজার। এর পর থেকে ওই বাজারটি সবার কাছে পরিষ্কার বাজার নামে পরিচিতি পায়। বর্তমানে সরকারিভাবেও এই এলাকার নাম পরিষ্কার বাজার।

এমন নামকরণের পেছনে কেবল বাজারের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাই নয়, আছে আরও এক কাহিনি। বাজারের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর মুখে শোনা সে গল্প বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। আজ থেকে অর্ধশতাব্দীর বেশি বছর আগের কথা। আক্তারুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি ছিলেন এই এলাকার বাসিন্দা। ব্যক্তিজীবনে লেনদেন থেকে সবকিছুতে স্বচ্ছতা বজায় রাখতেন। যাঁকে, যে কথা দিতেন, সেটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করতেন। গ্রামবাসীর কথায় ‘ওয়াদার বরখেলাপ’ তিনি কখনোই করতেন না। পোশাক–পরিচ্ছদেও তিনি সব সময় থাকতেন পরিচ্ছন্ন। এসব কারণে গ্রামের সবাই ‘পরিষ্কার’ নামে ডাকতেন। তাঁর নাম অনুসারেই এই বাজার।

আক্তারুজ্জামানের নাতি কামাল হোসেন একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দাদা ছিলেন অত্যন্ত স্বচ্ছ জীবনযাত্রার অধিকারী। লেনদেনসহ সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতাই ছিল তাঁর অন্যতম মাপাকাঠি। এ কারণে এলাকার লোকজন তাঁকে পরিষ্কার নামে ডাকতেন। পরে তাঁর নামেই বাজারের নামকরণ করা হয়। দাদার স্বচ্ছ জীবনাচারণের কথা যখন মানুষের মুখ থেকে যখন শুনি তখন গর্ব হয়।’

স্থানীয় সরকারবিভাগের ফলকে পরিষ্কার বাজারের নাম

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠার পর ব্যক্তি জীবনের মতো বাজার পরিচালনাসহ সবকিছুতেই স্বচ্ছতা বজায় রাখতেন আক্তারুজ্জামান। বাজারটিকেও সব সময় পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে তিনিসহ সব ব্যবসায়ী সজাগ থাকতেন। প্রায় দুই দশক আগে ৮০ বছর বয়সে আক্তারুজ্জামানের মৃত্যু হয়। এরপর তাঁর দেখানো পথে এখনো চলছে পরিষ্কার বাজার।

‘দাদা ছিলেন অত্যন্ত স্বচ্ছ জীবনযাত্রার অধিকারী। লেনদেনসহ সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতাই ছিল তাঁর অন্যতম মাপাকাঠি। এ কারণে এলাকার লোকজন তাঁকে পরিষ্কার নামে ডাকতেন। পরে তাঁর নামেই বাজারের নামকরণ করা হয়। দাদার স্বচ্ছ জীবনাচারণের কথা যখন মানুষের মুখ থেকে যখন শুনি তখন গর্ব হয়।’
কামাল হোসেন, বেসরকারি কলেজের শিক্ষক ও আক্তারুজ্জামানের নাতি ।

সরেজমিনে দেখা যায়, বাজারের চার দিক থেকে চারটি সড়ক এসে মিলেছে পরিষ্কার বাজারে। উত্তর দিক থেকে এসেছে কাঞ্চন বাজার সড়ক, দক্ষিণ দিক থেকে আট কপালিয়া বাজার সড়ক, পশ্চিম দিক থেকে পাঙ্খার বাজার সড়ক, আর পূর্ব দিক থেকে এসেছে পরিষ্কার বাজার রাস্তার মাথা সড়ক। সড়কগুলোর কোনো কোনোটি ভাঙাচোরা হলেও বাজার এলাকাটি অনেকটাই ভালো। সড়কের দুই পাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে ৭২টি দোকান। মুদি, মনিহারি, ওষুধ, আসবাবপত্র, কনফেকশনারি, চা, খাবারের দোকানসহ নানা পণ্যের দোকান রয়েছে সেখানে।

পরিষ্কার বাজারের একজন দোকানি

দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে পরিষ্কার বাজারে মুদিপণ্যের ব্যবসা করছেন মো. মোস্তফা (৬৩)। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গের সব দোকানদার মারা গেছেন। কেবল বেঁচে আছি আমি। এখন যাঁরা এই বাজারে দোকান করেন, তাঁরাও একসময় আমার কাস্টমার (ক্রেতা) ছিলেন। বাজারের নাম অনুসারে বাজারটিকে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে চেষ্টা করি আমরা।’

সত্তর বছরের বাসিন্দা সানা উল্যাহ প্রতিদিন আসেন পরিষ্কার বাজারে। তিনি বলেন, আক্তারুজ্জামানের হাত ধরেই এই বাজারের প্রতিষ্ঠা। বাজার প্রতিষ্ঠাকালে তাঁর মধ্যে যতটা না ছিল ব্যবসায়িক চিন্তা, তার চেয়ে বেশি ছিল মানুষের উপকার করার ইচ্ছা। কারণ আশপাশের কয়েক মাইলের মধ্যে তখন বাজার ছিল না। মানুষজন অনেক দূরে যেতে হতো নিত্যপণ্য কেনার জন্য। এই বাজার প্রতিষ্ঠার ফলে এলাকার বাসিন্দাদের অনেক কষ্ট কমেছে।

আরেক বাসিন্দা আবুল খায়ের বলেন, আক্তারুজ্জামান জনগণের কল্যাণে বাজার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিজের ৪০ শতাংশের বেশি জায়গা দিয়েছেন স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য। এলাকার কেউ যখন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দিতে রাজি হচ্ছিলেন না, তিনি তখন জমি দিয়ে বাড়ির পাশে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেন। এই বিদ্যালয়, বাজার যত দিন থাকবে তত দিন তিনিও তত দিন বেঁচে থাকবেন সবার হৃদয়ে।