প্রথম আলো গত ২৭ বছরে সত্য, নিরপেক্ষ ও দেশপ্রেমিক সংবাদ প্রকাশে যে সাহসের পরিচয় দিয়েছে, তা যেন আগামী দিনেও অব্যাহত থাকে—এমন প্রত্যাশা জানিয়েছেন সুধীজনেরা। চুয়াডাঙ্গা ও মুন্সিগঞ্জে অনুষ্ঠিত সুধী সমাবেশে তাঁরা বলেছেন, যত দিন বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে, তত দিন প্রথম আলো সত্য পরিবেশনায় আপসহীন হয়ে থাকুক। সঠিক ও নির্ভরযোগ্য খবর প্রকাশের কারণে প্রথম আলোর ওপর পাঠকের আস্থা বেশি। এই আস্থা যেন অব্যাহত থাকে।
প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে আজ সোমবার বিকেলে দুই জেলায় এ আয়োজন করা হয়। এতে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা, রাজনীতিক, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। তাঁরা প্রথম আলোর সাহসী সাংবাদিকতার প্রশংসা করার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রত্যাশার কথা জানান।
চুয়াডাঙ্গায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ভিক্টোরিয়া জুবিলি সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মিলনায়তনে। জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু হয় সুধী সমাবেশ।
অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, ‘সাধারণত প্রিন্ট পত্রিকা পড়ার সুযোগ হয় না। অনলাইন পত্রিকা বেশি পড়ি। যেদিন প্রথম আলোটা দেখতে পাই না, সেদিন মনে হয়, আজ কোনো সংবাদপত্র ওলটানো হয় নাই।’
প্রথম আলোর কাছে প্রত্যাশা নিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমরা পাঠক, যাঁরা নিরপেক্ষ সংবাদ চাই, সত্য সংবাদ চাই, দেশপ্রেমিক সংবাদ চাই; আমরা চাই, সত্যের পথে থাকবে প্রথম আলো।’ প্রথম আলোর সাফল্য কামনা করে তিনি বলেন, ‘যত দিন বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে, তত দিন প্রথম আলো সত্য পরিবেশনায় আপসহীন হয়ে থাকবে এবং দেশপ্রেমিক পরিবেশনা দেবে।’
সংবাদপত্রকে জাতিকে দেখার জানালা উল্লেখ করে জেলার সিভিল সার্জন হাদী মো. জিয়া উদ্দিন বলেন, প্রথম আলো দুই যুগের বেশি সময় ধরে সেই কাজ করে আসছে। মানুষের সঙ্গে সরকারের যে সংযোগ, সেই সংযোগ তৈরি করে সংবাদপত্র। অবিচার, দুর্নীতি—সবকিছু প্রকাশ্যে আনে সংবাদপত্র। এটা এমন একটি প্লাটফর্ম, যেখানে সব ধরনের তথ্য থাকে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী—সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে লিখে থাকে।
শুরু থেকে প্রথম আলো পড়ে আসছেন বীর প্রতীক সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘২৭ বছর ধরে দেখছি, এর (প্রথম আলো) মধ্যে কোনো ধাপ্পাবাজি নেই।’
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে দলীয় প্রার্থী শরীফুজ্জামান শরীফ বলেন, সত্যই শক্তি—সেই বিশ্বাসকে প্রথম আলো ২৭ বছর ধরে আঁকড়ে ধরেছে। আগামী বছরগুলোতে যেন তা অব্যাহত থাকে। বক্তব্যে একই ধরনের আশা প্রকাশ করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী হাসানুজ্জামান সজীব।
প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধি শাহ আলমের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক তারেক মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘পাঠকের ভালোবাসা আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। আপনারা প্রথম আলো পড়ছেন, প্রথম আলোর ওপর আস্থা আছে বলেই আজ প্রথম আলো এই অবস্থানে এসেছে। আপনারা সঙ্গে আছেন বলেই প্রথম আলো সত্য প্রকাশের সাহস পায়। যত দিন আপনারা প্রথম আলো পড়বেন, তত দিন প্রথম আলো থাকবে।’
বক্তব্যে তারেক মাহমুদ জানান, যে দল যখনই ক্ষমতায় এসেছে, প্রথম আলো বৈরী আচরণের শিকার হয়েছে। ভুল ধরিয়ে দিতে গেলেই শত্রু ভাবা হয়েছে। তবে প্রথম আলো সব সময় ভালোর সঙ্গে, সত্যের সঙ্গে থাকে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান চলাকালে প্রথম আলো পড়ে অনেকেই নিশ্চিত হয়েছেন, আসলেই কী ঘটছে। অনলাইনে পেজ ভিউ ছিল ৩৫ কোটি। প্রিন্ট ভার্সন বেড়েছিল দেড় লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যন ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট পত্রিকা পাঠকের ৫৭ শতাংশ প্রথম আলো পড়েন।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি শামীম রেজা ডালিম, চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক রাজীব হাসান, চুয়াডাঙ্গা আবৃত্তি পর্ষদের পরিচালক মনোয়ারা খুশি, এনসিপির জেলা সমন্বয়ক খাজা আমিরুল বাশার (বিপ্লব), বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক আসলাম হোসেন (অর্ক)।
সুধীজনদের বক্তব্য শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ইকবাল আতাহার তাজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হান্নান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিনিধি জহুরুল হক আজিজি, অরিন্দম সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শান্ত আহমেদ, সাংবাদিক আবুল হাশেম ও জাসাস সম্পাদক সেলিমুল হাবীব জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর কাছে প্রশ্ন করেন। প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক তারেক মাহমুদ এসব প্রশ্নের উত্তর দেন।
মুন্সিগঞ্জে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় জেলা পরিষদের সম্মেলনকক্ষে। সেখানে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য কাজী আবু সুফিয়ান বলেন, হাসিনা সরকারের ১৬-১৭ বছর স্বাধীনভাবে কথা বলাই দুরূহ ছিল। সে সময় প্রথম আলো সাহসের সঙ্গে প্রতিদিন সত্য তুলে ধরেছে। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ছেপে গেছে।
অনুষ্ঠানে মুন্সিগঞ্জ সরকারি হরগঙ্গা কলেজের ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি মো. শাহীন মিয়া বলেন, ‘দেশের সব গণমাধ্যম আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো গণমাধ্যম নিজেরাই সরকারের লেজুড়বৃত্তি করে চলত। তখন সঠিক খবরটি পেতে প্রথম আলোর দিকেই আমরা তাকিয়ে থাকতাম।’
অনুষ্ঠানে জেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক ও মুন্সিগঞ্জ-১ আসনের প্রার্থী এ কে এম ফখরুদ্দীন রাজী বলেন, প্রথম আলোকে আরও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করতে হবে। জেলার সংবাদগুলো গুরুত্বসহকারে তুলে ধরতে হবে।
মুন্সিগঞ্জ-২ আসনের জামায়াত মনোনীত প্রার্থী ও দলটির কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্য এ বি এম ফজলুল করিম বলেন, ‘সবার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সংবাদ পরিবেশন করে যেতে হবে। দুর্নীতি, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে লিখতে হবে। যদি কোনো সংবাদ আমাদের বিরুদ্ধে যায়, সেটাও লিখতে হবে।’
প্রথম আলোতে আরও বেশি মানুষের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরার অনুরোধ জানান মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনে জামায়াতের প্রার্থী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মো. আবু ইউসুফ।
সুধী সমাবেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পাশাপাশি বক্তব্য দেন সরকারি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। প্রথম আলোর সংবাদে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিসহ সার্বিক চিত্র ফুটে ওঠে উল্লেখ করে মুন্সিগঞ্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ কাজী হূমায়ুন রশিদ বলেন, ‘প্রথম আলোতে আমাদের নেগেটিভ সংবাদ যেমন আসে, তেমনি বিভিন্ন ভালো কাজের সংবাদ ছাপা হয়। ভালো সংবাদ থেকে আমরা উৎসাহিত হই। আমরা আরও সাহসী হয়ে সাহস সঞ্চার করে আরও ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হই।’
অনুষ্ঠানে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমা নাহার বলেন, ‘যখন থেকে পত্রিকা পড়ি, তখন থেকেই প্রথম আলো পড়ি। পত্রিকাটি পড়ে মনেই হয়নি এর বয়স মাত্র ২৭ বছর হয়েছে। পত্রিকাটির সাহসী, বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সংবাদের কারণে শুরু থেকেই পাঠকের আস্থার শীর্ষ স্থান দখল করে আছে। আমরা পত্রিকাটিকে সব সময় তাঁর সাহসী ও নিরপেক্ষ অবস্থানেই দেখতে চাই।’
বন্ধুসভার বন্ধু মাসফিক সিহাবের সঞ্চালনায় সুধী সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন মুন্সিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি বাসিরউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক সুজন হায়দার, মুন্সিগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মো. সফিকুল ইসলাম, রামপাল মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর হাসান প্রমুখ। সমাবেশে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধি ফয়সাল হোসেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রথম আলোর বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বক্তব্য দেন প্রথম আলোর আঞ্চলিক সংবাদবিষয়ক সম্পাদক তুহিন সাইফুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘পাঠকই আমাদের মূল শক্তি। আমরা ২৭ বছর ধরে যাঁদের জন্য টিকে আছি, তাঁরা হলেন এই পাঠক। এই পাঠকের মধ্যে শিক্ষক আছেন, সংস্কৃতির মানুষ আছেন, রাজনীতির মানুষ আছেন, সমাজসেবী আছেন। পাঠকদের জন্য সত্য সংবাদ লিখতে সাহস পাই। পাঠকদের ভালোবাসায় প্রথম আলো এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ২০২৫ সালে ওয়ান-ইফরার থেকে বিশ্বসেরার দুটি ও ইনমা থেকে দক্ষিণ এশিয়া থেকে সেরা হওয়ার তিনটি পুরস্কার অর্জন করেছে।’
সুধী সমাবেশে প্রশ্নোত্তর পর্বে পাঠকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন প্রথম আলোর আঞ্চলিক সংবাদবিষয়ক সম্পাদক তুহিন সাইফুল্লাহ। সুধীজনদের পরামর্শগুলো গুরুত্বসহকারে লিখে নেন এবং সেগুলো বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন।
সমাবেশে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সরকারি হরগঙ্গা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. ফারুখ মিয়া, জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা ঝোটন চন্দ, মুন্সিগঞ্জ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আ. হালিম, অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি মো. ইকবাল হোসেন, এনসিপির সিরাজদিখান উপজেলার সমন্বয়ক আলী নেওয়াজ, শিক্ষাবিদ খালেদা খানম, নারীনেত্রী হামিদা খাতুন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তি শিশির রহমান প্রমুখ।