
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘যাঁরা এত দিন নির্বাচন নির্বাচন করে জনগণকে বেহুঁশ করে তুলেছিলেন, এখন তাঁরা কেউ কেউ ভিন্ন সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, তাঁরা যে সমস্ত কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে পরিচালনা করছেন, বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের আগামী নির্বাচনে লাল কার্ড দেখানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছেন।’
আজ শনিবার সিলেট নগরের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জামায়াতে ইসলামীসহ আট দলের বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শফিকুর রহমান এ কথা বলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘একদল চাঁদাবাজির কারণে জনগণের ঘৃণা কুড়িয়েছে, আরেক দল আবার তার চেয়ে বেশি শক্তি নিয়ে চাঁদাবাজিতে নেমে পড়েছে। একদল দখলদার বনতে গিয়ে জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, আরেক দল বেপরোয়া দখলদার হয়ে উঠেছে। একদল জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, আরেক দল একই পথ ধরেছে, এমনকি নিজেদের মধ্যে মারামারিতে নিজেদের শেষ করে দিচ্ছে।’
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আলাদাভাবে গণভোট করাসহ পাঁচ দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত মজলিস, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি।
‘অপকর্মের’ দায় নিয়ে ফ্যাসিস্টরা বাংলাদেশ থেকে পালালেও ফ্যাসিজমের কালো ছায়া বাংলাদেশ থেকে যায়নি বলে উল্লেখ করেন জামায়াতের আমির। তিনি বলেন, ‘একদল যে অপকর্ম করে চলে গিয়েছে, আরেক দল বাংলাদেশে সেই অপকর্মের দায়িত্ব নিয়েছে। কেউ যদি চিন্তা করেন জনগণের সমর্থন পাব না, তাহলে বাঁকা পথে প্রশাসনিক ক্যু-এর মাধ্যমে আমরা নির্বাচনের ক্রেডিট হাইজ্যাক করব, তাঁদের বলব, বন্ধু সেই সূর্য ডুবে গেছে, এই সূর্য আর বাংলাদেশে উঠবে না। এই কালো সূর্য আর বাংলাদেশের মুখ দেখবে না। এখন নতুন সূর্যের উদয় হবে, সেই সূর্য কোরআন বুকে নিয়ে উদিত হবে ইনশা আল্লাহ। বাংলাদেশ থেকে অপশাসন দূর হবে।’
আট দলের বাইরে থাকা ইসলামী দলগুলোকে আট দলের জোটে আসার আহ্বান জানান জামায়াতের আমির। তিনি বলেন, ‘দেশপ্রেমিক সব ইসলামি দল এবং আরও কিছু দেশপ্রেমিক দল মিলে আটদলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। দু–একটি ইসলামি দল এখনো বাইরে আছে। আমি বন্ধুদের অনুরোধ করব, সব ধরনের মোহের জাল ছিন্ন করে আপনারা আপনাদের আঙিনায় চলে আসুন। এ আঙিনা আপনাদের আঙিনা।এখন যেখানে ঘোরাফেরা করছেন, এটা আপনাদের আঙিনা না।’
সংস্কার প্রশ্নে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে শফিকুর রহমান বলেন, ‘দফায় দফায় এত রক্ত এত ত্যাগের পর দেশবাসী কি আশা করেছিল? দেশবাসী আশা করেছিল, অতীতের অপকর্মের যে পরিণতি সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজনীতিবিদেরা নতুন রাজনীতি শুরু করবেন। কিন্তু আমরা দুঃখের সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি, একদল সেই পুরাতন ধারায় পড়ে আছে। তারা কোনো সংস্কারে রাজি না, তারা সনদ বাস্তবায়নে রাজি না, তারা গণভোটেও প্রথমে রাজি ছিল না। তারপর ধাক্কায়-ধুক্কায় সেই গণভোট এক দিনেই হতে হবে, তা তারা বাধ্য করেছে সরকারকে।’
ইসলামি ও দেশপ্রেমিক নেতারা কারও রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না উল্লেখ করে জামায়াতের আমির বলেন, ‘বিশ্বের সকল শান্তিকামী সভ্য দেশকে আমরা সম্মান জানাই। কিন্তু কেউ যেন আমাদের কোনো দাদাগিরি করতে না আসেন। আমরা আর কোনো দাদাগিরি দেখতেও চাই না, বরদাশত করতেও রাজি নই। বাংলাদেশ চলবে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ মোতাবেক এই দেশের জনগণের পছন্দে।’
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের মানুষ সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি বলেও মন্তব্য করেছেন জামায়াতের আমির। তিনি বলেন, বর্গিরা চলে যাওয়ার পর দেশের ভেতরে চিল যারা ছিল, সেই চিলগুলো ছোঁ মেরে জনগণের সম্পদ নিয়ে চলে গেছে। দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে বাইরে পাচার করেছে। দেশে দেশে বেগমপাড়া গড়ে তুলেছে। কেউ কেউ পালাতে গিয়ে খালে-বিলে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার রসিক সিলেটবাসীর কাছে কেউ কেউ কলাপাতায় ধরা পড়েছে।
সমাবেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির চরমোনাইর পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশের মধ্যে ৫৩ বছর পর্যন্ত যাঁরা আমাদের জিম্মি করে রেখেছিলেন, তাঁদের চরিত্র আমরা দেখি যে তাঁরা নিজেদের কাছে নিজেরা নিরাপদ নন। আজকে তাঁরা নিজেরা নিজেদের খেয়ে ফেলছেন। দুঃখ হয় আজকে এত গুম হলো, খুন হলো, লাখ লাখ নেতা-কর্মী যুগ যুগ পর্যন্ত তাঁদের জীবন বিপন্ন করেছেন জেলের মধ্যে। আমরা হতবাক আজকে সংস্কারের বিষয়ে বাধা, দৃশ্যমান বিচারে বাধা। এখন ওরা পাগল হয়ে গেছে নির্বাচনকে পেছানোর জন্য। আপনারা যত শয়তানি পরিকল্পনা করবেন ততই বাংলাদেশের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন।’
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ফ্যাসিবাদী আমলে ১৫ বছর রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়ন, জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ইসলামপন্থীরা। এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিদেশি আধিপত্যবাদী শক্তির বাংলাদেশি ক্রীড়নকদের হাতে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ নিগৃহীত হয়েছেন, কারা নির্যাতিত হয়েছেন, ফাঁসিকাষ্ঠ বরণ করতে হয়েছে। তবু অন্যায়ের সামনে জুলুমের সামনে তাঁরা মাথা নত করেননি। বাংলাদেশবিরোধী বিদেশি আধিপত্যবাদী শক্তি আবার বাংলাদেশে নতুন আরেক শক্তির ঘাড়ে সওয়ার হওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, জুলাই সনদের বিপক্ষে যারা ‘না বাক্সের’ জন্য ক্যাম্পেইন করবে, জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করবে।
খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আবদুল বাছিতের সভাপতিত্বে সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ইসলামী ঐক্যজোটের আমির মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির আমির সরওয়ার কামাল আজিজী, জাগপার সহসভাপতি রাশেদ প্রধান, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির চেয়ারম্যান এ কে এম আনোয়ারুল ইসলাম, জামায়াতে ইসলামীর সিলেট জেলার আমির হাবিবুর রহমান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মাহমুদুল হাসান, নেজামে ইসলামী পার্টির প্রচার সম্পাদক আবদুল্লাহ মাসুদ খান প্রমুখ। সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য দেন সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির ফখরুল ইসলাম।
বিভাগীয় সমাবেশ উপলক্ষে সকাল থেকে দলে দলে সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করেন আট দলের নেতা-কর্মীরা। দুপুর ১২টায় হাজার হাজার নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে সমাবেশ শুরু করা হয়। বিকেল চারটার দিকে সমাবেশ শেষ হয়। সিলেটের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সারা দেশে আট দলের বিভাগীয় সমাবেশ শেষ হলো।