সাব্বীর হোটেলে একসঙ্গে ৬০ থেকে ৬৫ জন বসে খাবার খেতে পারেন। সম্প্রতি তোলা
সাব্বীর হোটেলে একসঙ্গে ৬০ থেকে ৬৫ জন বসে খাবার খেতে পারেন। সম্প্রতি তোলা

নওগাঁয় স্বাদে–মানে এগিয়ে সাব্বীর হোটেলের বিরিয়ানি

উৎসব-অনুষ্ঠানে ভূরিভোজে জনপ্রিয় খাবারগুলোর একটি বিরিয়ানি। আবার বিশেষ কোনো উপলক্ষ না থাকলেও এই খাবারের স্বাদ নিতে ব্যাকুল থাকেন অনেকেই। চাহিদার কারণে দেশের ছোট-বড় শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জের হাটবাজারেও গড়ে উঠেছে অসংখ্য বিরিয়ানির দোকান।

সারা দেশের মতো নওগাঁ শহরের বিভিন্ন এলাকায় আছে অনেক বিরিয়ানির দোকান। তবে স্বাদ, গন্ধ ও মানে সবার চেয়ে এগিয়ে সাব্বীর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। নওগাঁয় যেন বিরিয়ানি আর সাব্বীর—এই দুটি শব্দ একে অপরের সমার্থক হয়ে উঠেছে।

খাসির বিরিয়ানি ও মোরগ পোলাওয়ের জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত এই হোটেলে কাচ্চি, ভাত, মাছ-মাংসের পদ ছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের মিষ্টি ও দই। হোটেলটির অবস্থান নওগাঁ শহরের ধর্মতলা রোডের আটাপট্টিতে।

শহরের ব্যস্ততম এলাকায় যানজট পেরিয়ে ভেতরে ঢোকাটাই যেন এক যুদ্ধ। এরপর আরেক যুদ্ধ—টেবিল খালি পাওয়া। তবে বিরিয়ানি মুখে দিলেই সব যুদ্ধ ভুলে যান ভোজনরসিকেরা। এ কারণেই প্রতিদিন নওগাঁ শহরের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন এখানে।

৫০ বছরের পথচলা

সাব্বীর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের বয়স পেরিয়ে গেছে ৫০ বছর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে এর সুনাম ও ক্রেতা। তবে এই হোটেলের শুরুটা ছিল বেশ সাধারণ—পরোটা, রুটি, ডাল আর চা দিয়ে।

১৯৭৪ সালে ইদ্রিস আনছারী ও সায়রুন্নেসার বড় ছেলে সাব্বীর আনছারী তখন কিশোর। দোকানের মালিক ইদ্রিস আনছারী নিজে রুটি ও পরোটা বানাতেন, আর ছেলে সাব্বীর আনছারীর দায়িত্ব ছিল খাবার পরিবেশন করা।

১৯৮০ সালে বাবার দোকানে প্রায় ছয় বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা হয় সাব্বীরের। ওই বছর এক ব্যবসায়ীর অনুষ্ঠানের জন্য মোরগ পোলাও রান্নার অর্ডার পান ইদ্রিস আনছারী। বাবার পরামর্শে সাব্বীর ২ কেজি চালের পোলাও ও ১০টি মুরগি রান্না করেন। কিন্তু রান্না শেষে দেখা যায়, খাবার নিতে কেউ আসছে না। সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়।

এ সময় এলাকার যুবক মোশতাক সন্ধ্যায় রুটি খেতে দোকানে এসে পোলাও দেখে আগ্রহী হন। তিনি পোলাও ও মুরগির রোস্ট খেতে চান। সাব্বীরের রান্না করা খাবার খেয়ে তিনি খুবই তৃপ্ত হন। হাফ প্লেট পোলাও ও হাফ বাটি মুরগির মাংস খেয়ে প্রশংসা করেন। সেই দিন পোলাও-মাংসের দাম ছিল ১৩ টাকা। দোকান থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফিরে আসেন মোশতাক। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত অনেকে সেদিন সাব্বীরের রান্না করা মোরগ পোলাও খান। এতে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হন সাব্বীর। পরদিন ৩ কেজি চালের পোলাও ও ১২টি মুরগি রান্না করা হয়। সেদিনও সব খাবার শেষ হয়ে যায়।

টিনশেড থেকে ভবন

তখন দোকানটি ছিল টিনশেড বেড়ার ছোট একটি ঘর। বসার ব্যবস্থা ছিল মাত্র ছয়জনের। ধীরে ধীরে সুনাম ছড়াতে থাকে। পরে বসার ব্যবস্থা বাড়িয়ে ১২ জন করা হয়। তবু অনেকেই জায়গা না পেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন।

এ সময় বাবা ইদ্রিস আনছারী আগের তুলনায় দোকানে সময় দেওয়া কমিয়ে দেন। সাব্বীর নিজেই রান্না শুরু করেন। রান্নার কাজে সহায়তা ও খাবার পরিবেশনের জন্য সাইফু নামের এক যুবককে নিয়োগ দেওয়া হয়। এভাবেই বছর পেরোতে থাকে, বাড়তে থাকে ব্যবসার পরিধি।

বর্তমানে সাব্বীরের নিজের পাঁচতলা ভবন রয়েছে। দোতলায় রেস্টুরেন্ট, তিনতলায় কমিউনিটি সেন্টার, চারতলায় স্টোররুম এবং পাঁচতলায় রান্নার ব্যবস্থা। যে টিনশেড ঘরে একসময় হোটেল ব্যবসা শুরু হয়েছিল, সেখানে এখন দই ও মিষ্টির দোকান।

হোটেলের ক্যাশ কাউন্টারে সাব্বীর আনছারী

চার ভাইয়ের যৌথ প্রয়াস

সাব্বীর আনছারীরা চার ভাই। ছোট ভাই শামীম আনছারী ও শফিক আনছারী হোটেল ব্যবসা দেখাশোনা করেন। সাব্বীর আনছারীর বয়স এখন প্রায় ৭৫ বছর। তিনি নিয়মিত মিষ্টির দোকানে বসেন।

নতুন ভবনের দোতলার রেস্টুরেন্টে বিরিয়ানি, পোলাও, ভাত, মাছ-মাংস, ভর্তা-ভাজি পরিবেশন করা হয়। এখানে একসঙ্গে ৬০ থেকে ৬৫ জন বসে খাবার খেতে পারেন। দুপুরের পর ও রাত ৯টার দিকে এখানে ভিড় সবচেয়ে বেশি থাকে।

খাবারের দাম ও বিক্রি

খাসির বিরিয়ানি প্রতি প্লেট ২০০ টাকা, মোরগ পোলাও ও কাচ্চি ১৮০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। আশপাশের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও আয়োজনে নিয়মিত খাবারের অর্ডার আসে। পবিত্র রমজান মাসে তৈরি করা হয় নানা ধরনের ইফতারি।

বর্তমানে এখানে কর্মচারীর সংখ্যা ২৫। প্রতিদিন দুপুর ও রাত মিলিয়ে ৭০০ থেকে ৮০০ জন খাবার খান। প্রতিদিন বিরিয়ানি, কাচ্চি ও সাদা পোলাও মিলিয়ে রান্না হয় ৮০ কেজি আতপ চাল। ভাতের জন্য আলাদাভাবে রান্না হয় আরও ৬০ কেজি চাল। প্রতিদিন ৭০ থেকে ৭৫ কেজি খাসির মাংস ও ৮০ থেকে ৯০টি মুরগি রান্না করা হয়। স্থানীয় বাজার থেকেই মাংস সংগ্রহ করা হয়। এখানে শুধু দেশি মুরগি ও খাসির মাংস ব্যবহার করা হয়। গরু বা পোলট্রি মুরগির মাংসের কোনো পদ নেই।

সাব্বীর আনছারী জানান, তাঁদের দোকানে খাসির বিরিয়ানি ও মোরগ পোলাও সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। ছয় থেকে সাত বছর আগে কাচ্চি চালু করা হয়েছে। অনেক ক্রেতা ভাত-ভর্তা-মাছও খেতে পছন্দ করেন। মুরগি ও হাঁসের লটপটি জনপ্রিয় আইটেম, বিশেষ করে শীতকালে হাঁসের লটপটির চাহিদা বেশি। বিরিয়ানিতে স্থানীয় মিলে ভাঙানো খাঁটি শর্ষের তেল ব্যবহার করা হয়, যা এর স্বতন্ত্র স্বাদের অন্যতম কারণ।

সাব্বীর আনছারী বলেন, ‘এখনো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করি। আগে আমার ছোট তিন ভাই হোটেল ব্যবসা দেখভালে সাহায্য করত। এখন দুই ভাই নিয়মিত ব্যবসা দেখভালে সাহায্য করে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও মানসম্মত খাবার পরিবেশনের জন্য ২০১৮ সালে নওগাঁ জেলার সেরা হোটেলের পুরস্কার পেয়েছি জেলা প্রশাসন থেকে। খুব বেশি পড়ালেখা করতে পারিনি আমি। তবে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছে। সততার সঙ্গে ব্যবসা করে এত দূর এসেছি। যত দিন বাঁচি সততার সঙ্গেই ব্যবসা করে যেতে চাই।’