বাড়িতে বসে কাপড়ে নকশা করছেন গৃহিণী শারমিন আক্তার। সম্প্রতি লোহাগাড়া উপজেলায় চরম্বা ইউনিয়নের মাইজবিলা গ্রামে
বাড়িতে বসে কাপড়ে নকশা করছেন গৃহিণী শারমিন আক্তার। সম্প্রতি লোহাগাড়া উপজেলায় চরম্বা ইউনিয়নের মাইজবিলা গ্রামে

স্বামীর জন্য পাঞ্জাবির নকশা করতে গিয়ে শুরু, এখন তিনি সফল উদ্যোক্তা

গৃহিণী থেকে সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন লোহাগাড়ার শারমিন আক্তার। নিজের বাড়ির বারান্দায় বসে পাঞ্জাবি, থ্রি–পিস, কুর্তি থেকে বাচ্চাদের জামা পর্যন্ত হ্যান্ড পেইন্ট করেন তিনি। মাসে আয় করেন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।

অবসর পেলেই বারান্দায় বসেন শারমিন আক্তার (২৯)। তুলির আঁচড়ে একের পর এক নকশা ফুটিয়ে তোলেন নির্জীব কাপড়ে। আঁকেন ফুল, পাতাসহ রংবেরঙের চিত্র। হ্যান্ড পেইন্টের এ কাজ করেই এখন গৃহিণী থেকে সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন শারমিন।

শ্বশুরবাড়িতেই স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকেন শারমিন। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা সদর থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক হয়ে তিন কিলোমিটার উত্তরে বার আউলিয়া গেট। সেখান থেকে আরও আট কিলোমিটার পূর্বে চরম্বা ইউনিয়নের মাইজবিলা গ্রামের মধু ফকির পাড়ায় শারমিনের শ্বশুরবাড়ি। পাঁচ বছর আগেও শারমিন ছিলেন পুরোপুরি গৃহিণী। এখন একদিকে সংসার, অন্যদিকে সামলান নিজের ব্যবসা। সবকিছু মিলে মাসে আয় করেন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির বারান্দায় বসে একটি পাঞ্জাবিতে নকশা বুনন করছেন শারমিন। সাদা রঙের পাঞ্জাবিটিতে ফুটে উঠছে নীল রঙের পাতার বাহার। কাজের এক ফাঁকে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাঞ্জাবি, থ্রি–পিস, কুর্তি থেকে শুরু করে বাচ্চাদের জামা—সব ধরনের পোশাকেই হাতের কাজ করেন তিনি। মুঠোফোনে তিনি এসব নকশার অর্ডার নেন। এরপর চাহিদামতো ঢাকার পোশাক কারখানা থেকে কুরিয়ারে কাপড় আনেন। কাজ শেষে ছবি তুলে নিজের ফেসবুক পেজে প্রচার করেন। এভাবেই দিন যায় তাঁর।

‘বিভিন্ন অজুহাতে নারীদের ঘরবন্দী না করে তাঁদের প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ দেওয়া উচিত। শারমিনের আগ্রহ ও দক্ষতা দেখে তাঁর পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।’
আবদুল্লাহ আল মামুন, শারমিনের স্বামী।

শারমিনের দুই সন্তান রয়েছে। এর মধ্যে বড় সন্তান রাওয়াহা তাফান্নুমের বয়স চার আর রুফাইদা তারান্নুমের বয়স এক বছর।  তাঁর স্বামী আবদুল্লাহ আল মামুন পেশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনিই এ উদ্যোগে শারমিনকে সহায়তা করেন।

শারমিন জানান, ২০২০ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। বিয়ের পরের বছর ঈদে স্বামীর জন্য একটি পাঞ্জাবি পেইন্ট করতে গিয়ে এই উদ্যোগের কথা মাথায় আসে। পরে একই সময়ে আরও ১৫টিতে হাতে নকশা করেন তিনি। এরপর তাঁর স্বামী মামুন বিক্রির জন্য এসব পাঞ্জাবির ছবি ফেসবুকে প্রচার করেন। এক সপ্তাহেই সব পাঞ্জাবি বিক্রি হয়। মাত্র ১২ হাজার টাকার পুঁজিতে সেবার ৮ হাজার টাকা লাভ করেন তিনি।

ঈদের আগের এ ছোট্ট উদ্যোগের পর শারমিনের কাজের সুনাম আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। একে একে ফরমাশ বাড়তে থাকে। ২০২২ সালে ‘শারমিনস্ হ্যান্ড পেইন্ট’ নামে ফেসবুক পেজ খোলেন তিনি। সেখান থেকেই এখন নিয়মিত অর্ডার পান। এখন তিনি মাসে গড়ে ৫০টি পোশাক পেইন্ট করেন। তবে পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানের মৌসুমে কাজের পরিমাণ আরও বাড়ে তাঁর।

গত বছর ঈদে ১৫০টিরও বেশি পোশাকের অর্ডার পেয়েছিলেন শারমিন। এতে তাঁর আয় হয় প্রায় ৭০ হাজার টাকা। শারমিন বলেন, ‘নিজের ইচ্ছাশক্তি ও পরিবার থেকে সহযোগিতা পেলে নারীরা অনেক কিছু করতে পারেন। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ উদ্যোগ আরও বড় করতে পারব, যাতে অবহেলিত নারীরাও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পান।’

নকশার পর বাড়ির উঠানেই কাপড় শুকাতে দিয়েছেন শারমিন আক্তার। সম্প্রতি তোলা

শারমিনের স্বামী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বিভিন্ন অজুহাতে নারীদের ঘরবন্দী না করে তাঁদের প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ দেওয়া উচিত। শারমিনের আগ্রহ ও দক্ষতা দেখে তাঁর পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। ভবিষ্যতে উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে নারীদের পরিচালনায় একটি বুটিক শপ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।’

শারমিনের মতো এমন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করছেন প্রশাসনও। জানতে চাইলে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের লোহাগাড়া উপজেলা কার্যালয়ের ক্রেডিট সুপারভাইজার মো. দিদারুল আলম বলেন, ‘নারীদের এগিয়ে যেতে হলে প্রান্তিক পর্যায়ে এমন উদ্যোগের বিকল্প নেই। যাঁরা এমন উদ্যোগ নিতে চান, আমরা আর্থিক সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করব। সফল নারী উদ্যোক্তাদের জয়িতা পুরস্কার দিয়ে সম্মানিতও করা হবে।’