
ভোরের আলো ফুটতেই একে একে ডোঙা নিয়ে হাজির হচ্ছেন কারিগরেরা। গাড়ি থেকে নামিয়ে সারিবদ্ধভাবে রাখা হচ্ছে ডোঙাগুলো। কেউ শেষ মুহূর্তের আঁচড়ে নিখুঁত করছেন ডোঙা, কেউ আবার ক্রেতার সঙ্গে দরদামে ব্যস্ত। বেলা বাড়ার আগেই দূর–দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন ক্রেতারা। এভাবেই জমে উঠছে হাট।
ডোঙা বেচাকেনার এই গ্রামীণ হাট নড়াইল সদর উপজেলার তুলারামপুর বাজারে। বাজারের একটি বড় রেইনট্রি গাছের নিচে প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও সোমবার বসে এই হাট। ভোর থেকে শুরু হয়ে হাট চলে দুপুর পর্যন্ত। ডোঙার হাট বসে শুধু বর্ষা মৌসুমেই।
ডোঙা মূলত ডিঙি নৌকার চেয়ে ছোট ও লম্বাটে জলযান। তালগাছ কেটে বানানো হয় বলে এর আরেক নাম ‘তালের ডোঙা’। নড়াইল সদর উপজেলার চর-শালিখা গ্রামের কারিগরেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই ডোঙা তৈরি করে তুলারামপুরের হাটে বিক্রি করেন।
গত শুক্রবার হাটে কথা হয় চর-শালিখা গ্রামের কারিগর মো. সজীবের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বহু আগেরতে আমাগের গ্রামের লোকজন ডোঙা বানায়। আমরা প্রায় ২৫ বছর ধইরে ডোঙা বানাচ্ছি। নিজেরা বানায়ে নিজেরাই বেচি। প্রথমে আমরা বিভিন্ন এলাকা ঘুইরে তালগাছ কিনি। এরপর শ্রমিক ভাড়া করে গাছ কাইটে ডোঙা বানায়। পরে তুলারামপুর হাটে আইনে বেচি।’
একটি তালগাছ থেকে দুটি ডোঙা তৈরি করা যায়। গাছ কাটা থেকে তৈরি শেষ করতে চারজন কারিগরের এক দিন সময় লাগে। পূর্ণবয়স্ক তালগাছ দিয়েই ভালো ডোঙা হয়। বাবার পেশা ধরে রাখা কারিগর নজরুল শেখ বলেন, ‘তালগাছের মান অনুযায়ী মালিকের কাছেরতে একেকটা তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কিনি। এট্টা গাছে দুইডে ডোঙা হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে একেকটা ডোঙা দুই থেকে তিন হাজার টাকা লাভ থাকে আমাগে। পানি বাড়ায় এ বছর ডোঙার চাহিদা ভালোই।’
বিক্রেতা ইয়াদুল শেখ বলেন, ‘সার আছে এরাম ডোঙা ছয় হাজার থেকে শুরু কইরে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করি। এই ডোঙা ১২ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত টেকে। অসার গাছের ডোঙা বিক্রি হয় তিন-চার হাজার টাকায়, আর এরাম ডোঙা চার-পাঁচ বছরের বেশি দিন টেকে না।’
স্রোতহীন, কম গভীর জলে পারাপার, মাছ ধরা, শাপলা তোলা, ধান-পাট কাটা, শামুক সংগ্রহ—এসব কাজে তালের ডোঙা স্থানীয় লোকজনের সহজ ও সুলভ বাহন। বৃষ্টি বেশি হলে খাল-বিল ও মুক্ত জলাশয়ে পানি বাড়ে, আর তখনই ডোঙার ব্যবহারও বেড়ে যায়। এ বছর শুরু থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে, হাটে ক্রেতার ভিড় বেড়েছে।
মাগুরা থেকে ডোঙা কিনতে আসা রমেশ বিশ্বাস বলেন, ‘আমাগেরর বাড়ির একপাশে নদী, আরেক পাশে বিল। ওহানতে মাছ ধরব, এই জন্যি ডোঙা কিনতে আইছি। হাট ঘুইরে ডোঙা দেখতিছি, দাম একটু বেশি মনে হচ্ছে। যদি পছন্দ হয় আর দামে পড়ে, তাহলে একখান ডোঙা কিনে নিয়ে যাব।’
একটি ডোঙা কিনেছেন নিরঞ্জন ঘোষাল। তিনি বলেন, ‘আমাগের একটা মাছের ঘের আছে। ঘেরে মাছের খাবার দেব, শামুক কুড়াব। এই জন্যি ১০ হাজার টাকা দিয়ে একটা ডোঙা কিনিছি। ঘের পর্যন্ত ডোঙা নিতি আমার আরো এক হাজার টাকা খরচ হবে।’
শুধু স্থানীয় ক্রেতা নন, আশপাশের জেলা থেকেও পাইকাররা আসেন। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে এই হাট থেকে ডোঙা কিনে বিক্রি করছেন যশোরের মনিরামপুরের আনন্দ দত্ত। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির সময় হলি আমি এই ডোঙার ব্যবসা করি। ভালোই লাভ হয়। একবার চার হাটের লাভের টাকা দিয়ে বাড়িতে একখান ঘর তুলিছিলাম। এই ব্যবসা করেই ছেলেমেয়েরে পড়াশোনা করাইছি, সংসার চলতিছে। আজকে দুইডে ডোঙা কিনছি, আরও কেনব। যতদিন মানুষ ডোঙা কেনবে, আমিও ততদিন ব্যবসা করব।’
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) নড়াইল জেলা কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপক (প্রকৌশলী) সোলায়মান হোসেন বলেন, এ জেলার চর-শালিখা গ্রামেই শুধু তালের ডোঙা তৈরি হয়। শতাধিক পরিবার এ কাজে জড়িত। তাঁরা আদি পেশা হিসেবে এটি ধরে রেখেছেন, আর তাঁদের তৈরি ডোঙার মান অনেক ভালো। তুলারামপুরের হাট থেকে এই ডোঙা যশোর, ফরিদপুর, মাগুরা, রাজবাড়ীসহ সারা দেশে চলে যায়।
কারিগরদের সহযোগিতার বিষয়ে সোলায়মান হোসেন বলেন, ‘তাঁদের পণ্যের প্রসারের জন্য বিসিক কাজ করছে। আর্থিক, ঋণ, প্রযুক্তি ও বাজারজাতকরণে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের পেশা যাতে টিকে থাকে, বিসিকের সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’