
তিন বছরের বেশি বিরতির পর আবার কীর্তনখোলা নদীর বুক ছুঁয়ে যাত্রী নিয়ে বরিশালে ভিড়ল ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমার পি এস মাহসুদ। শুক্রবার সন্ধ্যায় স্টিমারটি বরিশালে নোঙর করে। পুরোনো স্টিমারঘাটের পুনর্নির্মাণকাজ চলমান থাকায় নগরের ত্রিশ গোডাউন এলাকায় অবস্থিত বিকল্প ঘাটে নোঙর ফেলতে হয় স্টিমারটিকে।
পি এস মাহসুদের প্রত্যাবর্তনের সাক্ষী হতে বিকেল থেকেই ত্রিশ গুদাম এলাকায় জমতে থাকে উৎসুক মানুষের ভিড়। সবারই অধীর অপেক্ষা—কখন কীর্তনখোলার জলে প্যাডেলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে নতুনরূপে ফিরবে সেই চিরচেনা স্টিমার; উত্তরের হাওয়ায় ভেসে আসবে পুরোনো হুঁইশেলের ডাক।
এ এক ভিন্ন অনুভূতি—ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। নদীর রূপ-লাবণ্য, নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবিকাসংক্রান্ত নানা গল্প দেখতে দেখতে বরিশালে এসেছি। এটি শুধু যাতায়াত নয়; আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহনকারী এক জীবন্ত যান। একে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।মহিউদ্দীন আহমেদ, যাত্রী ও সাবেক সচিব
অপেক্ষার অবসান ঘটে সন্ধ্যা সাতটার দিকে। বাতাসে ভেসে ওঠে হুঁইশেলের শব্দ। সগৌরবে এগিয়ে এসে নোঙর করে পি এস মাহসুদ। বরিশালবাসীর জন্য তা যেন এক অনন্য অনুভূতির মুহূর্ত।
ঢাকা থেকে শুক্রবার সকাল আটটায় বরিশালের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে স্টিমারটি। দুপুর ১২টায় চাঁদপুরে বিরতি শেষে বেলা একটায় আবার যাত্রা শুরু হয়। প্রথম দিনের যাত্রায় স্টিমারটিতে প্রথম শ্রেণির ১২টি কেবিনে ছিলেন ২৩ জন এবং তৃতীয় শ্রেণিতে ছিলেন সাতজন যাত্রী।
ঐতিহ্যবাহী স্টিমারযাত্রার প্রথম দিনের যাত্রী হয়ে বরিশালে আসেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মহিউদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এ এক ভিন্ন অনুভূতি—ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। নদীর রূপ-লাবণ্য, নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবিকাসংক্রান্ত নানা গল্প দেখতে দেখতে বরিশালে এসেছি। এটি শুধু যাতায়াত নয়; আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহনকারী এক জীবন্ত যান। একে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। নদীকেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশেও এর বড় ভূমিকা থাকবে।’
গত মে মাসে স্টিমার চালুর সিদ্ধান্ত নেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবে পিএ স মাহসুদ সংস্কার করে চলাচলের উপযোগী করা হয়। অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা, জরিপ, ফিটনেস প্রতিবেদনসহ সব আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আজ আবার নদীপথে ফিরল শতবর্ষী এই জলযান।
ঐতিহাসিক নকশা ও কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে স্টিমারটির ইঞ্জিন, নিরাপত্তা ও অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা আধুনিক করা হয়েছে। যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল নেভিগেশন ব্যবস্থা, আধুনিক কেবিন, পর্যটকবান্ধব ডেক এবং আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা সরঞ্জাম। পরিবেশবান্ধব, কম ধোঁয়া নির্গমনকারী ইঞ্জিন ব্যবহার করায় নদীদূষণও কমবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো পি এস মাহসুদ শতবর্ষ ধরে বড় কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই নিরাপদ যাত্রীসেবা দিয়ে এসেছে। স্টিমারটির ভেতরে যুক্ত হয়েছে বিশেষ আকর্ষণ ‘হেরিটেজ কর্নার’। এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে শতবর্ষী এই প্যাডেল স্টিমারে ভ্রমণ করা খ্যাতনামা ব্যক্তিদের স্মৃতি, পুরোনো নেভিগেশন যন্ত্র, প্রাচীন নকশা ও ঐতিহাসিক নিদর্শন—যেন একসঙ্গে ইতিহাস ও ভ্রমণের আনন্দ। পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বয়া ও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখা হয়েছে।
ঢাকা থেকে বরিশাল যাত্রায় যাত্রীরা উপভোগ করতে পারবেন ঐতিহ্যবাহী খাবার—ফিশ কাটলেট, স্মোকড ইলিশ ও ফিশ ফ্রাই। দীর্ঘ যাত্রায় শিশুদের জন্য নিচতলায় রাখা হয়েছে ‘কিডস জোন’, যেখানে কিছু রাইডের ব্যবস্থাও রয়েছে। শিশুদের বিনোদনের পাশাপাশি স্টিমারের নিচতলায় ছোট একটি মঞ্চে লাইভ মিউজিক উপভোগের সুযোগ আছে; চাইলে যাত্রীরাও সেখানে গান পরিবেশন করতে পারবেন।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) জানায়, স্টিমারটির আসনসংখ্যা ৩২৩ হলেও বয়স বিবেচনায় বর্তমানে ১০০ থেকে ১৫০ যাত্রী পরিবহন করা হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির মোট ২২টি কেবিনে দুজন করে মোট ৪৪ জন যাত্রী ভ্রমণ করতে পারবেন। দোতলার মাঝের অংশে তৃতীয় শ্রেণিতে প্রায় ৫০ জন যাত্রীর বসার ব্যবস্থা রয়েছে, যা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নয়। ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে—শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ডাবল কেবিনের জন্য ৪ হাজার ৫২১ টাকা, নন-এসি ডাবল কেবিন ৩ হাজার ৩০০ টাকা এবং তৃতীয় শ্রেণি বা সুলভের ভাড়া ৬০০ টাকা।
বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) এস এম আশিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিনে দুটি স্টিমারের পুনর্বাসনকাজ শেষ হয়েছে। আপাতত একটি স্টিমার সপ্তাহে এক দিন চলবে। ঢাকার আশপাশে ভাড়াভিত্তিক ভ্রমণের সুযোগও রাখা হবে।
নদীবিধৌত বরিশালের জলযাত্রার ইতিহাসে স্টিমারের ভূমিকা অবিচ্ছেদ্য। একসময় দক্ষিণবঙ্গের মানুষের চলাচল ছিল স্টিমারনির্ভর। ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর স্টিমারসেবা বন্ধ হলে দেড় শ বছরের ঐতিহ্য থেমে যায়। গত মে মাসে বরিশাল সফরে নৌপরিবহন উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দেন। এর পর থেকেই বরিশালবাসী অপেক্ষায় ছিলেন স্টিমার ফেরার খবরে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটিশ আমলে ১৮৮৪ সালে স্টিমারের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে নারায়ণগঞ্জ ও পরে ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত চলাচল করত কয়লাচালিত প্যাডেল স্টিমার। পথে চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, মোরেলগঞ্জসহ একাধিক ঘাটে যাত্রাবিরতি ছিল। একসময় ফ্লোটিলা কোম্পানির ১৪টি স্টিমার এই নৌপথে চলাচল করত—পিএস গাজী, পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহসুদ, পিএস লেপচাসহ আরও কয়েকটি ছিল বহরে।
যাত্রী ও নাব্যতা–সংকটে ২০১৯ সাল থেকে স্টিমার চলাচল সীমিত হয়। খুলনার বদলে যাত্রা থামে মোরেলগঞ্জে। সর্বশেষ ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা–মোরেলগঞ্জ রুটে যাত্রা বন্ধ হয়। এখন সপ্তাহে এক দিন স্টিমার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও প্রতিদিন চালুর দাবি উঠেছে।
বরিশাল যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক দেওয়ান আবদুর রশিদ বলেন, ব্রিটিশ আমলের এই প্রযুক্তিগত বিস্ময় সভ্যতার স্মারক। জীবন্ত ইতিহাস হিসেবে স্টিমার সংরক্ষণ জরুরি। ঢাকা–বরিশাল নৌপথে বেসরকারি লঞ্চ সিন্ডিকেটের একচেটিয়া প্রভাব কাটাতে প্রতিদিন অন্তত একটি স্টিমার চালুর দাবি জানান তিনি।
তবে বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক এস এম আশিকুজ্জামান বলেন, শতবর্ষী স্টিমারগুলোর সক্ষমতা সীমিত। মেরামত করে চালু করা সম্ভব হলেও আগের শক্তিতে ফেরা কঠিন। যাত্রার সময় বেশি লাগায় সব যাত্রী এতে আগ্রহী না–ও হতে পারেন, ব্যয় নির্বাহও চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে আবেগ নয়, বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।