১৯৩১ সালের ২৩ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের লন্ডনের একটি গবাদিপশু প্রদর্শনীতে মহাত্মা গান্ধী
১৯৩১ সালের ২৩ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের লন্ডনের একটি গবাদিপশু প্রদর্শনীতে মহাত্মা গান্ধী

নোয়াখালীতে আসলেই কি মহাত্মা গান্ধীর ছাগল চুরি হয়েছিল

নোয়াখালী সফরে গিয়ে ছাগল চুরি হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর—এমনই জনশ্রুতি যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। সত্যিই কি নোয়াখালী এসে ছাগল হারিয়েছেন শান্তি, সম্প্রীতি ও অহিংস রাজনীতির এই প্রবক্তা। ৭৯ বছর আগে মহাত্মা গান্ধীর সেই সফরে আসলে কী ঘটেছিল, সেই বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে প্রথম আলো।

শান্তি, সম্প্রীতি ও অহিংস রাজনীতির প্রবক্তা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী অর্থাৎ মহাত্মা গান্ধীর ছাগলের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের নোয়াখালীর একটা সম্পর্কের কথা জনশ্রুতিতে এখনো জাগরূক। জনশ্রুতিটি হলো, ১৯৪৬ সালে নোয়াখালীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় শান্তি সফরে এসে ছাগল হারিয়েছিলেন গান্ধী। কথিত ‘কাশেম ফৌজের’ লোকজন তাঁর ছাগলটি চুরি করে মাংস রেঁধে পাঠিয়েছিলেন নিরামিষাশী গান্ধীকে। আজ থেকে ৭৯ বছর আগের ওই সফরের নানা সচিত্র বিবরণ পাওয়া যায় সে সময়কার বিভিন্ন সংবাদপত্রে। তবে ছাগল চুরির ঘটনার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এমনকি এ নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনী ‘দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিয়েন্স উইথ ট্রুথ’ বইতেও কোনো উল্লেখ নেই। বিষয়টি জানার জন্য প্রথম আলো নানা তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছে। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের নথিপত্র বিশ্লেষণের পাশাপাশি বর্তমান কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। বেরিয়ে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য।

গান্ধী ও ছাগলের দুধ

গান্ধী বাছুরকে বঞ্চিত করে গরু বা মহিষের দুধ পানের বিরোধী ছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর দৃঢ় প্রতিজ্ঞাও ছিল। কিন্তু ১৯১৯ সালের দিকে তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর চিকিৎসক জানান, সুস্থ হতে হলে তাঁকে দুধ পান করতেই হবে। তখন গান্ধী জানালেন, তিনি গরু ও মহিষের দুধ পান থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন। তবে স্ত্রী কস্তুরবা পণ ভঙ্গ না করেই ছাগলের দুধ পানের পরামর্শ দেন গান্ধীকে। কস্তুরবার যুক্তি ছিল, মহিষ ও গরুর দুধ পান না করার প্রতিজ্ঞা ছিল। তাহলে ছাগলের দুধ খেলে সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হচ্ছে না।

নোয়াখালীর একটি গ্রামের পথে একাকী হাঁটছেন মহাত্মা গান্ধী

গান্ধী অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই প্রস্তাবে সম্মত হন। যদিও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এতে তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতির মূল চেতনা লঙ্ঘন করছেন। তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিয়েন্স উইথ ট্রুথ’ –এ তিনি নিজের এই দ্বন্দ্বের সমালোচনাও করেছেন। পাশাপাশি জ্ঞানী ব্যক্তিদের আহ্বান জানিয়েছেন, যদি কেউ ছাগলের দুধের বিকল্প হিসেবে পুষ্টিকর কোনো উদ্ভিজ্জ খাবারের কথা জানেন, তা যেন তাঁকে জানান। কিন্তু শত বছরেরও বেশি সময় আগে এমন বিকল্প তখনো ভারতবর্ষে এসে পৌঁছায়নি। গান্ধীকে তাই ছাগলের দুধ পান করতে হলো। ১৯৩১ সালে তিনি যখন লন্ডন সফরে যান, তখন সঙ্গে ‘নির্মলা’ নামের একটি ছাগলও ছিল। সে সময় টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন ও ছবি থেকে এমন তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়।

অশান্ত নোয়াখালী

১৯৪৬ সালের মধ্য আগস্টে কলকাতার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার প্রভাব আছড়ে পড়ে নোয়াখালীতেও। নোয়াখালী জেলায়ও সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হয়ে যায়। নোয়াখালীর সহিংসতার প্রকৃত চিত্র সে সময়ও পাওয়া যায়নি। দুর্গম গ্রামাঞ্চল থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পুরো চিত্র সংবাদমাধ্যমে তুলে আনা প্রায় অসম্ভব ছিল। তবে ১৯৪৭ সালের ১ মে প্রাদেশিক আইনসভা বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদের প্রশ্নোত্তরে দাঙ্গা সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়। পরিষদের কংগ্রেস দলের ডেপুটি লিডার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এক প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রসচিবের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি কে নসরুল্লা জানান, নোয়াখালী ও ত্রিপুরা জেলায় হানাহানিতে মোট ২৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে মিলিটারি ও পুলিশের গুলিতে ৬৭ জন মারা যান। দাঙ্গায় নোয়াখালীতে ১৭৮ জন ও ত্রিপুরায় ৪০ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া অসংখ্য ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন, ধর্মান্তরেরও অভিযোগ ওঠে। এমন একটি পটভূমিতে গান্ধী নোয়াখালী সফরের সিদ্ধান্ত নেন।

ভারতের ওরিয়েন্ট বুক পাবলিকেশন থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট প্রকাশিত সুকুমার রায়ের ‘নোয়াখালীতে মহাত্মা’ নামের বইয়ে গান্ধীর নোয়াখালী সফর সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। পাশাপাশি নোয়াখালীতে গান্ধী ট্রাস্টে এ–সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে। অন্তর্জালে খোঁজ করে সে সময়কার পত্রপত্রিকার নানা সংবাদও পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে গান্ধী যে ১৯৪৬ সালের ৭ নভেম্বর নোয়াখালী আসেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত করেই বলা যায়। চার মাস নোয়াখালীতে অবস্থান করে গ্রামে গ্রামে যান তিনি। ২ মার্চ পর্যন্ত তিনি ১১৬ মাইল হেঁটে সব মিলিয়ে ৪৭টি গ্রাম পরিদর্শন করেন। তিনি প্রতিদিন একটি করে মোট ৪৭টি শান্তি ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ সময় তিনি নিয়মিত প্রার্থনা সভা পরিচালনা ছাড়াও স্থানীয় মুসলমানদের সঙ্গে বৈঠক করে হিন্দুদের আস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন শান্তি পথপরিক্রমায় বিভিন্ন পর্যায়ে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর মতো নেতাও অংশগ্রহণ করেছিলেন।

নোয়াখালী সফর যে গান্ধীর নিজের সিদ্ধান্ত ছিল কোনো রাজনৈতিক চাপ নয়, তা–ও সুকুমার রায় তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন। তিনি লেখেন, ‘নোয়াখালীর দাঙ্গার সময় গান্ধীজি তখন দিল্লিতে। সেখানে এক ধর্মসভায় গান্ধীজি বলেন, “যেদিন হইতে আমি নোয়াখালীর খবর শুনিয়াছি, সেদিন হইতে আমার কর্তব্যের কথা ভাবিতেছি। ঈশ্বর আমাকে পথ দেখাইবেন। লোকে আমাকে ভালোবাসে।”’

ট্রাস্টে যোগদানের আগে থেকেই গান্ধীর ছাগল চুরি হওয়ার কথা শুনে আসছিলেন তিনি। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধীর সফরসঙ্গীদের লেখা পড়েছেন। ওই সব লেখায় ছাগল চুরির কোনো তথ্য ছিল না। গান্ধীর সঙ্গীরা সবাই মহাত্মা গান্ধীর প্রতিদিনকার কর্মসূচির দিনপঞ্জি আকারে লিখেছেন। এমন কোনো ঘটনা ঘটলে দিনপঞ্জিতে অবশ্যই তা থাকত। সে কারণে পুরো বিষয়টি লোকমুখে ছড়ানো গালগল্প বলেই মনে হয় তাঁর
রাহা নবকুমার, সচিব, গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট

দীর্ঘ সফরে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন মহাত্মা গান্ধী। নিপীড়নের শিকার হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি গিয়ে যেমন সান্ত্বনা দিয়েছেন তিনি, তেমনি দরিদ্র মুসলমান কৃষকের বাড়িতেও থেকেছেন। তাঁদের কাছাকাছি গিয়েছেন। এসব অভিজ্ঞতার কথা গান্ধী নিজের আত্মজীবনীতেও লিখেছেন। কিন্তু কোথাও ছাগল চুরির ঘটনার কথা লেখেননি তিনি। তৎকালীন কোনো সংবাদপত্রেও এ–সংক্রান্ত কোনো খবর প্রকাশিত হয়নি।

পত্রপত্রিকা ঘেঁটে জানা যাচ্ছে, সে সময় এডওয়ার্ড স্কিনার সিম্পসন নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নোয়াখালীর দাঙ্গা দিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন। তবে সরকার তা প্রকাশ করেনি। ১৯৪৬ সালের ১৩ নভেম্বরের প্রকাশিত দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় এর একটি সারসংক্ষেপ প্রকাশ পায়। ওই প্রতিবেদনেও ছাগল চুরির কোনো বিবরণ ছিল না।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অশান্ত নোয়াখালীতে শান্তি সফরে মহাত্মা গান্ধী

অ্যান্ড্রু হোয়াইটহেডের একটি লেখা

৮ মে ২০১০ সালে ব্রিটিশ লেখক অ্যান্ড্রু হোয়াইটহেড বিবিসিতে ভারতের ভাগ নিয়ে একটি রেডিও পডকাস্ট সিরিজ করেছিলেন। সেখানে নোয়াখালীর দাঙ্গার বিবরণ দেন তিনি। তাঁর প্রতিবেদনের প্রধান উৎস ছিল স্থানীয় লোকমুখে শোনা কথা।

হোয়াইটহেড লেখেন, নোয়াখালীতে মৃতের সংখ্যা হয়তো কলকাতা বা বিহারের তুলনায় কম ছিল। কিন্তু জাতিগত ঘৃণা, ধর্ষণ, সম্পদ হরণ এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরের প্রভাব সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।

নোয়াখালীর জয়াগ গ্রামের আবদুল রউফ নামের এক বাসিন্দার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে হোয়াইটহেড দাবি করেন, নোয়াখালীতে গান্ধীকে অনেকেই সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। কিন্তু কেউ কেউ অপছন্দও করেছে। তাঁর জন্য ছাগল সরবরাহ করা হয়েছিল দুধের প্রয়োজন মেটাতে। কিন্তু স্থানীয় মুসলমানেরা সেই ছাগল চুরি করে খেয়ে ফেলেছিল!

কেবল হোয়াইহেডের লেখায় নয়, এ দেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমে নানা সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও গান্ধীর ছাগল চুরির ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সেসব প্রতিবেদন কোনো সূত্রের কথা উল্লেখ করা হয়নি।

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর জয়াগ গ্রামে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট প্রাঙ্গণে মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্য। গত শনিবার তোলা

গান্ধীর নোয়াখালী সফর

১৯৪৬ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৯৪৭ সালের ২ মার্চ পর্যন্ত চার মাস গান্ধী নোয়াখালীতে অবস্থান করেন। এরপর বিহারের দাঙ্গা থামাতে তিনি সেখানকার উদ্দেশে নোয়াখালী ত্যাগ করেন। কেমন ছিল গান্ধীর নোয়াখালী সফর? গবেষক ও ইতিহাসবিদেরা তাঁদের লেখায় উল্লেখ করেছে, গান্ধী কেবল হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে অবিশ্বাস দূর করার কাজ করেননি, বরং গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনীতি, শিক্ষার বিষয়েও নানা পরামর্শ দিয়েছেন। কখনো মুসলিম বাড়িতে গিয়ে কালাজ্বরে আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। আবার কখনো মসজিদ পরিদর্শন করে সেখানে বসে পবিত্র কোরআন পাঠ শুনেছেন।

সুকুমার রায় তাঁর ‘নোয়াখালীতে মহাত্মা’ বইতে লেখেন, ‘গান্ধীজি যে গ্রামেই গিয়াছেন, সেখানেই সবাই সহিত অবাধে মেলামেশা করিয়াছেন। মুসলমানদের বাড়িতে তাঁহার নিমন্ত্রণের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাইতেছিল। তিনি কখনোই কাহাকেও বিমুখ তো করেনই নাই, বরং অত্যন্ত আগ্রহের সহিত সবার আমন্ত্রণ রক্ষা করিয়াছেন। তাহাদের বাটী (বাড়ি) গিয়া তাহাদের সুখ-দুঃখের খোঁজখবর লইয়াছেন। পরম আত্মীয়ের ন্যায় তাহাদের সহিত কথাবার্তা বলিয়াছেন। বাটীর শিশু ও বালক–বালিকাদের সহিত রসিকতা করিয়া সময় সময় গাম্ভীর্যপূর্ণ আবহাওয়াকে হালকা, হাস্যমুখর ও আনন্দমধুর করিয়া তুলিয়াছেন। পল্লিবাসী মুসলমানেরা গান্ধীজির দরদি হৃদয়ের পরিচয় পাইয়া ক্রমশ তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইতেছিলেন। প্রার্থনাসভায় মুসলমানগণ অধিক সংখ্যায় যোগদান করিতেছিলেন।’

১৯৪৬ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৯৪৭ সালের ২ মার্চ পর্যন্ত চার মাস গান্ধী নোয়াখালীতে অবস্থান করেন। এরপর বিহারের দাঙ্গা থামাতে তিনি সেখানকার উদ্দেশে নোয়াখালী ত্যাগ করেন। কেমন ছিল গান্ধীর নোয়াখালী সফর? গবেষক ও ইতিহাসবিদেরা তাঁদের লেখায় উল্লেখ করেছে, গান্ধী কেবল হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে অবিশ্বাস দূর করার কাজ করেননি, বরং গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনীতি, শিক্ষার বিষয়েও দিয়েছেন নানা পরামর্শ। কখনো মুসলিম বাড়িতে গিয়ে কালাজ্বরে আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। আবার কখনো মসজিদ পরিদর্শন করে সেখানে বসে পবিত্র কোরআন পাঠ শুনেছেন।

মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি হিন্দু গ্রামবাসীদের অভিযোগও শুনতেন গান্ধী। যাঁরা সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়েছেন, তাঁদের বাড়িতে গিয়েছেন অভয় দিতে। তাঁর শান্তি সমাবেশে হাজির হতেন উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। সেখানে সব ধর্মগ্রন্থ থেকেই পাঠ করা হতো। এসবে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছিল নোয়াখালীর পরিস্থিতি।

রায়পুরে গান্ধীর সফরের ঠিক আগেই হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল এবং সেখানে পাকিস্তান ক্লাব সাইনবোর্ডও টানানো হয়েছিল। কিন্তু গান্ধীর সফরের পরপরই পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। সুকুমার রায় লেখেন, ‘রায়পুরা গ্রামে আগমনের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থা সম্পূর্ণ অন্য রকম দাঁড়ায়। উদার ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য এই পরিবর্তনের কারণ বলিয়া স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়। রায়পুরার বহু মুসলমান বাসিন্দাকে গান্ধীর সম্মুখে ও পার্শ্ববর্তী পথে অনেক বেলা পর্যন্ত দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখা যায়। বাসিন্দা বাটী হইতে তাহাদের ছাগল লইয়া আসে ও তখনই দুগ্ধ দোহন করিয়া গান্ধীজির পানের জন্য দেয়।’

সুকুমার রায় তাঁর বইতে ছাগল চুরির কোনো ঘটনার কথা উল্লেখ করেননি, বরং মুসলমান বাড়িতে গান্ধী যে সাদরে আতিথ্য পেয়েছেন, তার বিবরণ আছে। সুকুমারের বইতে উল্লেখ রয়েছে, ‘পাঁচগাঁও যাইবার পথে গান্ধীজি দুটি মুসলমান বাটীতে (বাড়িতে) যান। পাল্লায় সান্ধ্যভ্রমণের সময় নাদু মোল্লা ও বাদু মোল্লা নামক দুজনের বাটীতে যান। নাদু মোল্লা ও বাদু মোল্লা দুই ভাই। তাঁহাদের বাটী পাশাপাশি। গান্ধীজি তাঁহাদের বহির্ব্বাটীতে উপস্থিত হইলে দুই ভাই গান্ধীজিকে কীভাবে অভ্যর্থনা করিবেন, তাহা লইয়া তাঁহাদের ব্যস্ততায় বিশেষ আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। একজন ছুটিয়া একটি ভাঙা চেয়ার আনিয়া গান্ধীজিকে বসিতে দেন। একটি টেবিলও আনা হয়। ঘরে কমলালেবু ছিল। গাছে ডাব তো আছেই। তখনই লোক দিয়া ডাব পাড়াইয়া, কমলালেবু ও ডাব দিয়া তাঁহারা তাঁহাদের মান্য অতিথিকে অভ্যর্থনা করেন। তাঁহারা গান্ধীজিকে বলেন যে তাঁহারা অত্যন্ত দরিদ্র। তাঁহাদের কিছুই নাই। গান্ধীজি উত্তরে বলেন, সে তো ভালোই, আমিও তো দরিদ্র।’

তথ্যের খোঁজে জয়াগ গ্রামে

ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানী থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট প্রকাশিত ‘নোয়াখালীতে মহাত্মা’ বইয়ের প্রচ্ছদ

জেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূর সোনাইমুড়ী উপজেলার জয়াগ গ্রাম। সোনাইমুড়ী-চাটখিল ও রামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের জয়াগ বাজারের উত্তর–পূর্ব দিকে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট। সড়কের দুই পাশে বন বিভাগের লাগানো ঘন সবুজ গাছগুলো যেন দীর্ঘ এক তোরণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জয়াগ বাজারের ভেতর দিয়েই প্রবেশপথ গান্ধী আশ্রমের। প্রধান ফটক পেরিয়ে সামনে যেতেই চোখ পড়ে মহাত্মা গান্ধীর বাণীসংবলিত নানা সাইনবোর্ড। দূর থেকে চোখে পড়বে গান্ধী স্মৃতি জাদুঘরের সামনে স্থাপন করা মহাত্মা গান্ধীর বিশাল আকারের ভাস্কর্য। ভাস্কর্যের পেছনের জাদুঘরে দেখা মিলবে নোয়াখালী অঞ্চলে গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত নানা চিত্র।

জনশ্রুতি আছে এই জয়াগ গ্রামেই গান্ধী তাঁর ছাগল হারিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালের ২৯ জানুয়ারি বুধবার গান্ধী জয়াগ গ্রামে আসেন। এখানে তিনি গ্রামের জমিদার ও নোয়াখালী জেলার প্রথম ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষের বাড়িতে ওঠেন। পরে গান্ধীর স্মরণে হেমন্ত কুমারের দান করা জায়গায় গড়ে ওঠে গান্ধী ট্রাস্টসহ বেশ কয়েকটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। জয়াগ গ্রামে মুসলমান প্রতিনিধিদের সঙ্গেও দেখা করেন গান্ধী। দাঙ্গার পর ব্যাপকভাবে মুসলমানদের গ্রেপ্তারের বিরোধিতাও করেন তিনি।

ছাগল চুরির এই জনশ্রুতি সম্পর্কে জানতে আমরা গিয়েছিলাম গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টে। ট্রাস্টের সচিব রাহা নবকুমারকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাস্টে যোগদানের আগে থেকেই গান্ধীর ছাগল চুরি হওয়ার কথা শুনে আসছিলেন তিনি। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধীর সফরসঙ্গীদের লেখা পড়েছেন। ওই সব লেখায় ছাগল চুরির কোনো তথ্য ছিল না। গান্ধীর সঙ্গীরা সবাই মহাত্মা গান্ধীর প্রতিদিনকার কর্মসূচির দিনপঞ্জি আকারে লিখেছেন। এমন কোনো ঘটনা ঘটলে দিনপঞ্জিতে অবশ্যই তা থাকত। সে কারণে পুরো বিষয়টি লোকমুখে ছড়ানো গালগল্প বলেই মনে হয় তাঁর।