চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী সড়কে ৭ আগস্ট সেতু ভেঙে দুই ভাগ হয়ে যায়
চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী সড়কে ৭ আগস্ট সেতু ভেঙে দুই ভাগ হয়ে যায়

যে কারণে ভেঙে দুই ভাগ হয়েছিল চট্টগ্রামের সেতুটি

জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের জন্য খালের প্রশস্ততা ও গভীরতা বাড়ানো হয়েছিল। দুই পাশে দেওয়া হয় প্রতিরোধ দেয়ালও। কিন্তু সড়কের ওপর থাকা ৫০ বছরের পুরোনো ইটের সেতুর প্রশস্ততা ও সংস্কার—দুটির কোনো কিছুই করা হয়নি। ফলে ভারী বর্ষণের সময় পাহাড়ি ঢলে পুরোনো সেতুর দুই পাশের মাটি সরে যেতে শুরু করে। একপর্যায়ে সেতুর ইটের তৈরি দেয়াল ভেঙে যায়। ফলে সেতুটির একটি অংশ দুই ভাগে ভেঙে পড়ে।

চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী সড়কে একটি সেতু ভেঙে কেন দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল, এর কারণ জানিয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। মোট চারটি কারণে সেতুটি ভেঙে দুই ভাগ হয়েছে বলে জানিয়েছে কমিটি। আজ বুধবার তিন পাতার প্রতিবেদন জমা দেয় সিটি করপোরেশন গঠিত তদন্ত কমিটি।

তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিটি করপোরেশনের সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন। প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

৭ আগস্ট ভোর পাঁচটায় ভারী বর্ষণের সময় নগরের বায়েজিদ বোস্তামী সড়কের স্টারশিপ গলির মুখে ভেঙে যায় একটি সেতুর এক পাশ। শীতল ঝরনা খালের ওপর অবস্থিত এই সেতুর আরেক পাশ দিয়ে বর্তমানে যান চলাচল করছে। এই সেতু দিয়ে নগরের ২ নম্বর গেট থেকে অক্সিজেন এলাকায় যাতায়াত করেন লোকজন। নগরের ২ নম্বর গেট থেকে অক্সিজেনমুখী সড়কের ওপর থাকা সেতুর অংশ ভেঙে যায়। বর্তমানে অক্সিজেন থেকে ২ নম্বর গেটমুখী অংশ চালু আছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ২০১০ সালে পুরোনো সেতুর এই অংশ ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করেছিল। এই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ হাজার গাড়ি চলাচল করে।

দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে এবং ভবিষ্যতে তা এড়াতে করণীয় নির্ধারণে চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল সিটি করপোরেশন। কমিটি প্রধান করা হয় সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী আনিসুর রহমানকে। সদস্য হিসেবে ছিলেন সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা কমান্ডার ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রিফাতুল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান।

সেতু ভেঙে যাওয়ার চার কারণ

তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, সেতুটি ভেঙে পড়ার মূল কারণ হলো এর পুরোনো কাঠামো। প্রায় ৫০ বছর আগে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছিল ইটের তৈরি একটি ভিত্তি দেয়ালের (অ্যাবাটমেন্ট ওয়াল) ওপর, যা মাটি ঠেকিয়ে রাখে এবং সেতুর ভার বহন করে। তখন দুই পাশের দূরত্ব ছিল ছয় মিটার। পরে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজের সময় শীতল ঝরনা খালকে প্রশস্ত করে ১৩ মিটার করা হয় এবং গভীরতাও বাড়ানো হয়। ফলে সেতুর দৈর্ঘ্য খালের প্রশস্ততার সঙ্গে মেলেনি। ভারী বর্ষণের সময় পাহাড়ি ঢলে খালের তলদেশ থেকে মাটি সরে যেতে থাকে। এতে সেতুর ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ভেঙে যায়।

দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সেতুর পূর্ব পাশে পানি নিষ্কাশনের জন্য নালা করা হয়েছিল। এই নালার পানি সরাসরি সেতুর ভিত্তির (ফাউন্ডেশন) পাশে নিষ্কাশিত হতো। এতে সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ ছাড়া তৃতীয় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেতুটি যখন নির্মাণ করা হয়েছিল তখন বায়েজিদ বোস্তামী সড়কে গাড়ি চলাচল করত খুব কম। এখন গাড়ির সংখ্যা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শিল্প এলাকা হওয়ায় সড়ক ও সেতু দিয়ে ভারী ট্রাক, লরি, কাভার্ড ভ্যানসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চলাচল করে। বেশি ওজনের গাড়ি চলাচলের কারণে সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

চতুর্থ কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে, পানি সরবরাহের জন্য ওয়াসা সেতুর পাশ দিয়ে দুটি বড় আকারের পাইপ নিয়েছে। এই স্থানে পাইপের সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। পাইপলাইনের সুরক্ষার জন্য আরসিসি বক্স নির্মাণ করা হয়েছে। এ কারণেও অনেক পুরোনো সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

দুর্ঘটনা এড়াতে চার সুপারিশ

নগরের অন্যান্য সেতুতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে চারটি সুপারিশ করেছে কমিটি। এগুলো হচ্ছে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য যেসব খালের প্রশস্ততা বাড়ানো হয়েছে, তার সঙ্গে মিল রেখে সেসব খালে থাকা পুরোনো সেতুগুলো ভেঙে নতুন করে করতে হবে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় অনেক খালের পাশে একাধিক সংস্থা প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ করেছে। বিশেষ করে সিডিএর খাল খননের ফলে খালের গভীরতা বেড়েছে। এতে আগের প্রতিরোধ দেয়ালগুলো দেবে যাচ্ছে। তাই পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিরোধ দেয়াল ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া অতি ভারী যানবাহন বহনে সক্ষম নয় এমন সেতু ও কালভার্টের তালিকা তৈরি করে নিরাপত্তা সাইনবোর্ড স্থাপন এবং প্রয়োজনে ভারী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে।

সেবা সংস্থার পাইপলাইন স্থাপন ও স্থানান্তরের সময় যাতে সেতু ও কালভার্টের ক্ষতি না হয়, তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয় কমিটি।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় শীতল ঝরনা খালের ওপর নতুন সেতু নির্মাণ করা হবে। ইতিমধ্যে সেতুর নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। ব্যয়ও ঠিক করা হয়েছে। যার পরিমাণ ৮ থেকে ৯ কোটি টাকা। নতুন সেতুর প্রশস্ততা হবে ২৩ মিটার। এর দৈর্ঘ্য ১৫ মিটার। আগে দৈর্ঘ্য ছিল ছয় মিটার। ঠিকাদার নিয়োগের জন্য ইতিমধ্যে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে সিটি করপোরেশন।