মাঠে উৎপাদিত লবণ গর্তে মজুত করার প্রস্তুতি চলছে। গত শুক্রবার বিকেলে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার হাজীপাড়ায়
মাঠে উৎপাদিত লবণ গর্তে মজুত করার প্রস্তুতি চলছে। গত শুক্রবার বিকেলে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার হাজীপাড়ায়

লবণের দাম নেমেছে কেজি পাঁচ টাকায়, গর্তে সংরক্ষণ

কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার উত্তর ধুরুং এলাকার চাষি মুমিনুল ইসলাম (৪৫) এবার ৬ কানি (কানিতে ৪০ শতক) জমিতে লবণ চাষ করছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লবণের উৎপাদনও ভালো হচ্ছে। গত শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ৬ কানি জমি থেকে ১ হাজার ২০০ মণ লবণ উৎপাদন করেছেন তিনি। তবে মাঠে উৎপাদিত লবণ নিয়ে হতাশ তিনি। কারণ, এক সপ্তাহ ধরে প্রতি মণ লবণের দাম ৬০ টাকা কমে নেমে এসেছে ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকায়। প্রতি কেজিতে লবণের দাম পড়ছে পাঁচ টাকারও কম।

গত শুক্রবার দুপুরে সরেজমিন কথা হয় লবণচাষি মুমিনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, জানুয়ারি মাসে লবণ বিক্রি হয় ২৪০ টাকায়। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে দাম ১৮০-১৮৫ টাকায় নেমে এসেছে। তাতে প্রতি মণ লবণের বিপরীতে চাষিদের ১৭০ টাকার মতো লোকসান হচ্ছে। কারণ, প্রতি মণ লবণ উৎপাদনের বিপরীতে চাষিদের খরচ হয় প্রায় ৩৫০ টাকা। এমন অবস্থা চলতে থাকলে চাষিদের পথে বসতে হবে।

দফায় দফায় লবণের দাম কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে মুমিনুল ইসলাম বলেন, মধ্যস্বত্বভোগী ও কার্গো বোটের মালিকেরা সিন্ডিকেট করে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছেন। কুতুবদিয়ার চার হাজারের বেশি চাষি লবণ চাষ করেন। সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে লবণ বিক্রির সুযোগ নেই। উৎপাদিত লবণ সমুদ্রপথে কার্গো বোটে করেই ঢাকা-চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ-খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠাতে হয়।

উত্তর ধুরংয়ের পাশের ইউনিয়ন লেমশীখালীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পাশাপাশি দুটি গ্রাম হাজারীপাড়া ও নুইন্যাঘোনা। দুই গ্রামের চার পাশে অন্তত ৮০০ একর জমিতে উৎপাদিত হচ্ছে লবণ। মাঠজুড়ে সাদা লবণের শতাধিক স্তূপ চোখে পড়ে। হাজারীপাড়ায় ৭ কানি জমিতে লবণ চাষ করছেন স্থানীয় চাষি শফি আলম। গত দুই মাসে তিনি ১ হাজার ৩০০ মণ লবণ উৎপাদন করেন। তিনি বলেন, গত বছর এই সময়ে প্রতি মণ লবণ বিক্রি করেছিলেন ৪৫০ টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮৫ টাকায়। লবণের দাম না বাড়লে অনেক চাষি উৎপাদন বন্ধ করে দেবেন।

লবণ মজুতের জন্য খনন করা হয়েছে পুকুর আকৃতির গর্ত

একই কথা জানান হাজারীপাড়ার চাষি আবুল বশর ও সিরাজুল ইসলাম। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, সিন্ডিকেট করেই লবণের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে চাষিরা লবণ উৎপাদন বন্ধ রাখেন। তাতে দেশে লবণের সংকট সৃষ্টি হলে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা যাবে।

গত শুক্র ও শনিবার দুই দিন কুতুবদিয়ার লেমশীখালী, আলী আকবরডেইল, বড়ঘোপ, কৈয়ারবিল, উত্তর ধুরুং ও দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নের অন্তত ৪০টি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে—৬ হাজার একরের বেশি জমিতে লবণের বাম্পার উৎপাদন চলছে। কিন্তু বেচাবিক্রি নেই বললেই চলে। কারণ জানতে চাইলে কয়েকজন চাষি বলেন, গত বছর তাঁরা প্রতি কানি জমি এক মৌসুমের জন্য (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ৫ মাস) লাগিয়ত (ইজারা) পেয়েছিলেন ৫০ হাজার টাকায়। এবার একলাফে ৩০ হাজার টাকা বেড়ে ৮০ হাজার টাকা করে পরিশোধ করতে হচ্ছে। তা ছাড়া মাঠে পলিথিন বিছানো, উৎপাদিত লবণ পরিবহন ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ খরচ বেড়েছে। যে কারণে প্রতি মণ লবণ উৎপাদনের বিপরীতে চাষিদের খরচ হচ্ছে ৩৫০ টাকার বেশি। প্রতি মণ লবণের দাম কমপক্ষে ৪০০ টাকা না পেলে চাষিরা লবণ চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। তখন উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে লবণ চাষে নামা ৮০ শতাংশ চাষি পথে বসবেন।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে কক্সবাজার জেলা সদর, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ৬৮ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত উৎপাদিত হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ। লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। বিসিক কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার পরও চাষিরা লবণ উৎপাদনে অনীহা প্রকাশ করছেন। কারণ, লবণের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। লবণের দাম কেন কমে গেল, তার কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

৫ হাজার গর্তে ১ লাখ মেট্রিক টন লবণ

কক্সবাজারের কোথাও লবণ মজুত কিংবা সংরক্ষণের গুদাম নেই। চাষিরা উৎপাদিত লবণ মাঠে গর্ত খুঁড়ে সংরক্ষণ করেন। জেলায় লবণ সংরক্ষণের কতটি গর্ত আছে—এ পরিসংখ্যান কারও নেই। তবে বিসিক ও চাষিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তত ৫ হাজার গর্তে ১ লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে দাম বেড়ে গেলে গর্ত থেকে তুলে সেই লবণ বিক্রি হবে।

বিসিকের লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, লোকসানেই লবণ বেচাবিক্রি করতে হচ্ছে চাষিদের। অনেক চাষি হতাশ হয়ে উৎপাদন বন্ধ রাখছেন। অনেকে লবণ বিক্রি না করে গর্তে সংরক্ষণ করছেন। টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, ঈদগাঁও, চকরিয়াতে অন্তত ৫ হাজার গর্তে বর্তমানে ১ লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুত রয়েছে। আকারভেদে প্রতিটি গর্তে লবণ ধরে ১০০ থেকে ১ হাজার মণ পর্যন্ত।

লবণ সংরক্ষণের গুদাম নেই কেন, তা জানতে চাইলে ইদ্রিস আলী বলেন, গুদামে লবণ মজুত করলে তা শুকিয়ে যায়। এতে ওজনও কমে যায়। গর্তে রাখলে শুকিয়ে যায় না। বরং নিরাপদে থাকে। ঝড়বৃষ্টি কিংবা জলাবদ্ধতাতেও গর্তের লবণ নষ্ট হয় না। গর্তের ভেতরে এসব লবণ পলিথিন মোড়ানো থাকে। গর্তের মুখও মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়।

পলিথিন বিছিয়ে চলছে লবণ উৎপাদন

চাষিরা মূল্য না পেয়ে লবণ গর্তে মজুত করে রাখছেন বলে জানান মহেশখালী লবণ চাষি ঐক্য সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি শাহাব উদ্দিন। তিনি বলেন, লবণের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে বহু চাষি হতাশ হয়ে পড়েছেন। অনেকে লবণ উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছেন।

বিসিকের দেওয়া তথ্যমতে, গত মৌসুমে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ৯ উপজেলায় ৬৮ হাজার ৫০৫ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছিল ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন, যা বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরুর ৬৩ বছরে সর্বোচ্চ উৎপাদন। কক্সবাজারে বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছিল ১৯৬০ সালে। ৪৪ হাজার প্রান্তিক চাষি, ১ লাখ শ্রমিকসহ জেলার অন্তত ১০ লাখ মানুষ লবণ উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

গত ১৮ জানুয়ারি কক্সবাজারের লবণের মাঠ পরিদর্শনে আসেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান। তিনি লবণ উৎপাদন কার্যক্রম পরিদর্শনের পাশাপাশি চাষিদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর জেলা প্রশাসন, লবণচাষি, লবণমিলের মালিক ও বিসিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। ওই বৈঠকে কক্সবাজার লবণচাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মো. মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, বাজারে প্যাকেটজাত প্রতি কেজি লবণ কিনতে হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। মাঠ থেকে বাজার পর্যন্ত লবণের দামের এত তারতম্য অনুসন্ধানের যেন কেউ নেই।